MUKTADHARA GOLPO / BASUDEB DAS

মুক্তধারা গল্প / প্রত্যয়

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA   GOLPO  BASUDEB DAS

গল্প

প্রত্যয়
বাসুদেব দাশ

তটিনী প্রত্যন্ত গ্রামের একটি মেয়ে। বাবা, বিরস মল্ল ফুটপাতে আলু পিয়াজ আদা বিক্রি করেন। গ্রামে গোলপাতার ছাওনি দেওয়া মাটির ঘর ওদের। তবে ইলেকট্রিক লাইন আছে গ্রামে। ভাই অনুরাগ উচ্চমাধ্যমিক পড়তে পড়তে বাবাকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করে। তটিনী বি এ বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে পড়ছে। ইচ্ছা আছে স্কুলের টিচার হওয়া। সে প্রাইভেট টিউটর ছাড়াই একা একা পড়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করেছে। অনেকটা রাস্তা সাইকেলে এসে সাইকেল স্টেশনে রেখে ট্রেনে করে রোজ রোজ কলেজে যায়। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মা বাবারও অনেক আশা ওকে নিয়ে। অনেকটা দূরের রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয় বলে মা বাবার মনে সব সময় একটা চাপা আতঙ্ক থাকে। দিন কাল একদমই ভাল না। রাজনৈতিক ডামাডোল মানুষকে স্বস্তিরনিঃশাস ফেলতে দিচ্ছে না। আবহাওয়া সব সময় গরম। অস্থির পরিবেশের মধ্যে মানুষকে জীবন হাতে নিয়ে চলতে হয়। স্কুল, কলেজ, হাট বাজার সর্বত্রই রাজনীতির দৈন্যদশা চোখে পড়ে। তটিনীদের পাড়ার কয়েকটা ছেলে তাকে বহু দিন ধরে বিরক্ত করছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার দিকে কুদৃষ্টিতে তাকায় কিন্তু তটিনী পাত্তা না দিয়ে চলে যায়। ওদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। ওদের গ্রামে বিরোধী পক্ষের কোন লোক নেই বললেই চলে। যেভাবেই হোক সবাই একই রাজনৈতিক দলের সমর্থক। তটিনীর বি এ থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে তাই কলেজের ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পর বাংলার প্রফেসর এক্সট্রা ক্লাস নিচ্ছেন । এক্সট্রা ক্লাস এটেন্ড করতে গিয়ে তটিনীর বাড়ি ফিরতে একটু রাত হয়ে যাচ্ছে। ট্রেন থেকে নেমে অনেকটা রাস্তা সাইকেলে করে আসতে হয়। বাবা এগিয়ে আনতে চাইলে মেয়ে রাজি হয় না। সে বলে আমি ঠিক এসে পড়বো। তোমরা চিন্তা করবে না। এই সময় একদিন আসার সময় পেরিয়ে অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরও মেয়ে বাড়ি আসছে না দেখে অনুরাগ সাইকেল নিয়ে দিদিকে এগিয়ে আনতে যায়। বেশ কিছুটা এগোনোর পর দেখে দিদির সাইকেলটা রাস্তার ধারে পড়ে আছে। কিন্তু দিদি নেই। 

এদিক ওদিক একটু খোঁজা খুজি করে দেখতে পায় মাঠের অপর প্রান্তে দিদিকে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা ছেলে রেপ করছে। দিদির মুখে কাপড় গুজে দিয়েছে ওরা। চুড়িদার ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ও কাছে যেতেই কয়েকজন ওকে খুব মারলো। অনুরাগ কোন রকমে দৌড়ে পালিয়ে এসে বাবা ও পাড়ার কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে ঐ মাঠে যায়। মাঠে গিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে খোঁজাখুঁজি করে দেখে দিদি বেহুস হয়ে পড়ে আছে। ধরে প্রাণ আছে কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না। বইয়ের ব্যাগটা মাঠে পড়ে আছে। সবাই মিলে একটা ভ্যান এনে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায় ও থানায় ডায়েরি করা হয় আর সকাল বেলা পঞ্চায়েতে জানানো হয়। কয়েক দিন ধরে পুলিশ তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালিয়েও গুন্ডাদের সন্ধান করতে পারেনি। পাড়ার পঞ্চায়েত পাড়ার লোকদের নিয়ে তদন্ত কমিটি তৈরি করে এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার জন্য পুলিশকে চাপ দেয়। সবার মুখে একটাই কথা তটিনীর এটা হলো কেন এবং কে বা কারা তাকে বলাৎকার করলো ? দুষ্কৃতীরা কোথায় লুকিয়ে আছে সেটা অনতিবিলম্বে খুঁজে বের করে তাদের উওযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। যে ছেলেগুলো তটিনীকে বিরক্ত করতো তাদের বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত কিছু শুনতে নারাজ। ওরা শাসক দলের কর্মী। আস্তে আস্তে খবরটা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রেডিও TV তে প্রচার হতে থাকে। বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল এটা নিয়ে মাঠে নেমে প্রপাগন্ডা শুরু করে দেওয়ায় সরকার একটু নড়েচড়ে বসে। কেসটা ধামা চাপা দেবার জন্য নানা মিথ্যা অজুহাত দেখানোর চেষ্টা চলছে সরকারি তরফে। মিটিং মিছিলে ভিড় করছে মানুষ। এই নিয়ে সারা রাজ্য তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তটিনী সুস্থ না হলে ঘটনার আসল তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। TV র চ্যানেলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে ঝগড়া ঝাটি বাঁধছে রোজরোজ। শাসক দল কেন ঐ ছেলেগুলোকে আড়াল করতে চাইছে সেটা নিয়েই তরজা। এই ভাবে একদিন দুদিন করে যেতে যেতে প্রায় একমাস বাদে তটিনী চিকিৎসায় একটু সারা দেয়। ডাক্তার বাবুদের পরামর্শ আরও মাস খানেক সময় দিতে হবে তটিনীকে স্টেটমেন্ট দেবার জন্য। অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এরপর আন্দোলনটা ধিকিধিকি করে চলতে থাকে। তটিনীর মোবাইলটা ওর বইয়ের ব্যাগের মধ্যে ছিল কিন্তু পাশ ওয়ার্ড জানা না থাকায় কেউ খুলতে পারেনি। তটিনী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসে চিন্তা করে যে সে কিভাবে এগোবে। বাবা মা চাইছেন এই অপরাধের যোগ্য শাস্তি হউক দুষ্কৃতীদের। কিন্তু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাপোর্ট থাকায় দুষ্কৃতীদের কেউ ছুঁতে পারছে না। এদের আদৌ শাস্তি দেওয়া যাবে কিনা সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। শেষ কালে পিছিয়ে আসতে হলে বিপদের শেষ থাকবে না। তথাপি তটিনী একদিন তার মোবাইলের ভয়েস রেকর্ড সাংবাদিকদের শোনায় এবং সব কথা খুলে বলে দেয়। সেখানে ঐ ছেলেগুলোর কন্ঠস্বর ও একে অপরের নাম ধরে ডাকা ডাকির রেকর্ড পাওয়া যায় । এটা খবরের কাগজে প্রকাশ হবার কয়েক দিন বাদে একদিন রাতের বেলা তটিনীদের বাড়ি কারা ভাঙচুর করে দিয়ে যায় । সেই দিন ঐ বাড়িতে ওরা ছিল না। ভয়ে আশংকায় ওরা অন্যাত্র সরে গেছে। ওকে চাকরির অফার দেওয়া হয় সরকারের তরফ থেকে। তটিনী এই চাকরি নিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয় । এক বছর ড্রপ দিয়ে তটিনী পরীক্ষা দিয়ে BA অনার্স পাশ করে। তারপর B ED কমপ্লিট করে একটা স্কুল শিক্ষিকার চাকরি পায় শিলিগুড়িতে । চারিদিকের চাপে সরকার ঐ ছেলেগুলোকে জেল হেপাজতে পাঠাতে বাধ্য হয় ।

 তটিনীরা আগের শাসনের বাড়ি বিক্রি করে শিলিগুড়িতে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করে । তটিনীরা মনে প্রাণে চাইছিলো যে ঐ দুষ্কৃতীদের উপযুক্ত শাস্তি হউক এবং এই ধরণের দুর্ঘটনা আর যাতে একটাও না ঘটে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হউক। তারা এটাও বুঝেছিল যে ওদের শাস্তি হবে না এবং এই রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাই অযথা দুঃশ্চিন্তা বাড়িয়ে কাজ নেই। ওরা এরমধ্যে থেকে সরে গেলে কেসটা আস্তে আস্তে ধামাচাপা পড়ে যায়। ঐ ছেলেগুলো ছাড়া পেয়ে পাড়ায় এসে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওদের দৌড়াত্ব আরও বেড়ে যায়। ওদের অত্যাচারে পাড়ার মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠে । তটিনীরা এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দাঁতে দাঁত চেপে সময়ের অপেক্ষা করতে থাকে। এই আপদ যতক্ষণ ঘাড়ের উপর নিঃশাস ফেলবে ততক্ষন বিপদেরও ভয় থাকবে। যে পরিবর্তনের ফল খারাপের থেকেও খারাপ সেই পরিবর্তনকে ধরে রাখার কোন অর্থ হয় না। তাই সামনের পঞ্চায়েত ভোটে রায় দানের জন্য গ্রামের মানুষ অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে আছে। সব মানুষের একটাই কথা সমূলে উৎপাটিত করতে হবে এই উৎপাতটাকে। পুলিশ এবং গুন্ডাদের মোকাবিলা করে বিরোধী পক্ষের জয় সুনিশ্চিত করতে গ্রামের মানুষ এককাট্টা। পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধী পক্ষের জয় সগৌরবে ঘোষিত হয়। তটিনীর উপর অত্যাচারের জন্য যে আগুন জ্বলে উঠেছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার শাসনে আজ তা গ্রাস করে ফেলেছে সারা বাংলাকে হাজারো তটিনীর উপর অন্যায়ের প্রতিশোধ হিসাবে। তটিনীদের প্রত্যাশা পূর্ণ হয় ।


 

Comments :0

Login to leave a comment