কম্বল বিতরণকে ইস্যুকে কেন্দ্র করে পঞ্চায়েত ভোটের আগে গোটা রাজ্যের জেলাশাসক, বিডিও এবং থানার আইসি-দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আতঙ্ক ধরিয়ে দিলেন মমতা ব্যানার্জি।
বনবিবির থানে পুজো দিয়ে এদিন সামসেরনগরে সরকারি সভাতে বিভিন্ন প্রকল্পের উপভোক্তাদের হাতে কাগজ তুলে দিয়ে মাইক ধরে বক্তৃতা শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী। হঠাৎই তাঁর মনে পড়ে যায় হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের জন্য তিনি নিজে কিনে এনেছেন ১৫ হাজার শীতবস্ত্র। হিসাব দিয়ে মমতা ব্যানার্জি ৫ হাজার কম্বল, ৫ হাজার চাদরের সঙ্গে ৫ হাজার সোয়েটার আনার কথা জানিয়ে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কাকে দিয়েছেন এগুলো? কোথায় রেখেছেন ১৫ হাজার?’’ জেলা শাসক শারদ দ্বিবেদী কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘নো। এই বিধানসভা কেন্দ্রের জন্যই আনা হয়েছে। কোথায় রাখা হয়েছে ? কেন বিডিও অফিসে রাখা থাকবে?’’
মঞ্চের নিচে অপেক্ষমাণ জনতা। আর মঞ্চ থেকে আধিকারিকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ধমক দেখে জনতার যারপরনাই খুশিতে হাততালি। এরপরই মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘যদি বিডিও ঠিকমতো কাজ না করে, থানার আইসি’রা ঠিকমতো কাজ না করেন, ডিএম-রা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করেন, আমাকে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।’’ মঞ্চ থেকেই এরপর মমতা ব্যানার্জি নির্দেশ দেন, বুধবার সকাল থেকে হিঙ্গলগঞ্জে ক্যাম্প করে শীতবস্ত্র বিতরণ করতে হবে।
ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকির পর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন গোটা জেলার ২২টি ব্লকের বিডিওকে বুধবার হিঙ্গলগঞ্জে তলব করেছে। এদিন রাতেই নদীনালা পার করে বসিরহাট মহকুমার বিডিওরা হিঙ্গলগঞ্জে আসতে শুরু করেছে। বুধবার সকালের মধ্যে জেলার বাকি ব্লকের বিডিওদের হিঙ্গলগঞ্জে চলে আসতে বলা হয়েছে। শুধু আসা নয়, যে বিডিও’র কাছে শীতবস্ত্র পড়ে আছে তাঁর নিজের ব্লক এলাকায় বিতরণ করার জন্য সেটাও রাতের মধ্যে সংগ্রহ করে চলে আসতে হচ্ছে হিঙ্গলগঞ্জে। ফলে বারাসত ১ নম্বর ব্লকের বিডিও নিজের এলাকার কাজ ছেড়ে বুধবার হিঙ্গলগঞ্জে এসে শিবির থেকে বিতরণ করবেন কম্বল। তাঁর নিজের এলাকার মানুষকে বঞ্চিত করে মমতা ব্যানার্জি নির্দেশ পালন করতে এমনই পরিকল্পনা করেছে জেলা প্রশাসন। কারণ, মঞ্চ থেকেই মমতা ব্যানার্জিকে জেলা শাসক শারদ দ্বিবেদীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘শারদ তোমার থেকে এটা আশা করিনি।’’
কিন্তু শীতবস্ত্র বিতরণ নিয়ে মমতা ব্যানার্জির উষ্মা সেই বস্ত্র বিতরণ কর্মসূচির কোনও পরিকল্পনা এদিন প্রশাসনিক বৈঠকে ছিল না। জেলা প্রশাসনের একাধিক সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে কোনোভাবেই শীতবস্ত্র বিতরণ ছিল না। এমনকি পরেও কোনও স্তর থেকে কর্মসূচি বদল করার কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। তারপরেও আকস্মিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী শীতবস্ত্র বিতরণের প্রসঙ্গ নিজে থেকেই উত্থাপন করে বলেন, ‘‘আমি কষ্ট করে এখানে আসবো বলে, তিনদিন ধরে এইসব কম্বল, চাদর, সোয়েটার কিনে এনেছি। আমি নিজে দেব বলে। কথা শোনা হয়নি কেন?’’ শীতবস্ত্র না আসা পর্যন্ত মঞ্চে গোঁ ধরে বসে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। বিডিও অফিস থেকে কিছু শীতবস্ত্র নিজের হাতে বিলিয়ে তবে নিস্কৃতি মেলে আধিকারিকদের।
প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী নিজে কম্বল কিনে এনেছেন বলে সরকার মঞ্চে দেওয়ার তাই কোনও পরিকল্পনা ছিল না। নিজের কিনে দেওয়া কম্বল কীভাবে সরকারি মঞ্চ থেকে বিতরণ করা হবে, প্রশ্ন তুলে আধিকারিকরা বলছেন, ‘‘এ তো পাড়ার ক্লাবের তরফ থেকে গরিব মানুষকে কম্বল বিতরণ করা হচ্ছে না।’’ আর সরকারি টাকাতেও যদি কেনা হয়ে থাকে তাহলে তা বিতরণ করার নির্দিষ্ট সরকারি নির্দেশিকা আছে। কাদের দেওয়া হবে, কীভাবে বণ্টন হবে তার গাইডলাইন মেনেই তা দেওয়ার কথা। প্রশাসনের সূত্র জানাচ্ছে, সরকারি টাকায় এই শীতবস্ত্র কেনা হয়নি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেনার পর সেই চাদর, কম্বলের ওপর বিশ্ব বাংলার প্যাকেটে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বিডিও, থানার আইসি’কে উদ্দেশ্য করে এদিন জনতার সামনে মুখ্যমন্ত্রী আসলে পরিকল্পিতভাবেই রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছেন। ‘‘উনি জনতার সামনে এদিন আধিকারিকদের টেনে নিচে নামিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন সরকার মানুষের কাছে সাহায্য করতে চায়। আসলে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আধিকারিকরা।’’ জানিয়েছেন রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তা। বক্তৃতার সময় তার ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘‘পুলিশ একটা অন্যায় করবে, দোষটা আমার ঘাড়ে পড়ে। সরকার একটা অন্যায় করলে, গালাগাল খাই আমি,’’ জানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি।
বগটুই গণহত্যার সময়ও একইভাবে মুখরক্ষার নামে পুলিশের ওপর দোষ চাপিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। মন্ত্রীসভার সহকর্মী পার্থ চ্যাটার্জির বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে চাকরি বিক্রির বিপুল টাকা উদ্ধারের পরও ‘‘আমি কিছু জানতে পারলাম না!’’ বলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। এদিনও তাঁর মুখ থেকে পুলিশ থেকে সরকারের দোষের দায় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে শোনা গিয়েছে, ‘‘অথচ আমি জানি না। আমার কোনও দোষ নেই।’’
সরকারি সভাতে মমতা ব্যানার্জির এহেন আচরণের পর দ্বীপাঞ্চলের মানুষের যে কাজে আসবে না তা জানাতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সরদার। বনবিবির পুজো দিলে সুন্দরবনের মানুষের জীবন-জীবিকার পরিবর্তন হবে? পঞ্চায়েতের পুকুর চুরি বন্ধ হবে? আবাস যোজনার টাকা দেদার লুট হচ্ছে। উপভোক্তারা নেতাদের বাটোয়ারা না দিলে পরের কিস্তির টাকা পান না। আদিবাসীদের বার্ধক্য ভাতার টাকা বন্ধ। ১১ মাস একশো দিনের কাজ বন্ধ। অসংখ্য মানুষের কাজের মজুরি বকেয়া পড়ে আছে। এদের কী হবে?’’ প্রশ্ন প্রাক্তন বিধায়কের।
Comments :0