Manab Mukherjee passed away

প্রয়াত কমরেড মানব মুখার্জি

কলকাতা

সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর প্রাক্তন সদস্য, রাজ্যের ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রাক্তন নেতা, বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী কমরেড মানব মুখার্জির জীবনাবসান হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ১১টা ১০ মিনিটে তিনি বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সহ পার্টির নেতৃবৃন্দ। মঙ্গলবার দুপুরেই তাঁর মরদেহ পার্টির কলকাতা জেলা দপ্তরে নিয়ে আসা হয় এবং কমরেড মানব মুখার্জির চোখ দান করা হয়। এদিন তাঁর মরদেহ পিস ওয়ার্ল্ড’এ রেখে দেওয়া হয়েছে, বুধবার বেলেঘাটায় পার্টির দপ্তরে, পার্টির রাজ্য দপ্তরে এবং কলকাতা জেলা দপ্তরে তাঁর মরদেহে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পরে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে তাঁর ইচ্ছানুসারে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য মরদেহ দান করা হবে। 
কমরেড মানব মুখার্জির ৬৭ বছর বয়স হয়েছিল। গত আগস্ট মাস থেকে তিনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসার পরে বাড়িতে ফিরে গেলেও সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ঈশিতা মুখার্জি এবং কন্যা হিয়া মুখার্জি রয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য সূর্য মিশ্র, এমএ বেবি, হান্নান মোল্লা ও তাঁর স্ত্রী মহিলা আন্দোলনের নেত্রী মায়মুনা মোল্লা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও শোকবিবৃতি দিয়েছেন। এদিন তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন মহম্মদ সেলিম, রবীন দেব, অনাদি সাহু, কল্লোল মজুমদার সহ পার্টির নেতৃবৃন্দ। কমরেড মানব মুখার্জির প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন এসএফআই’র রাজ্য সভাপতি প্রতীক উর রহমান ও রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য, ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহা ও রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জি। শোকপ্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠনের পক্ষ থেকেও। সুবক্তা, দক্ষ সংগঠক, সংস্কৃতি সচেতন ও সুলেখক মানব মুখার্জি বামপন্থী ছাত্র-যুব আন্দোলনে, সিপিআই(এম)’র নেতা হিসাবে গণআন্দোলনে এবং রাজ্যের মন্ত্রী হিসাবে যে অবদান রেখেছেন তা শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন সবাই। 
১৯৫৫ সালের ২৪ আগস্ট মানব মুখার্জির জন্ম। পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন। যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলে পড়াশোনার সময় থেকেই মানব মুখার্জি সংস্কৃতি চর্চায় যুক্ত হন ও ছাত্ররাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি সংস্কৃতি সংসদ নামের একটি সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ পাশ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এসএফআই’র দক্ষ সংগঠক ছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে এসএফআই’র কলকাতা জেলা কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন, সংগঠনের সিইসি সদস্যও ছিলেন। ১৯৮৬ সালে মানব মুখার্জি ডিওয়াইএফআই’র সঙ্গে যুক্ত হন এবং পরের বছর ডিওয়াইএফআই’র কলকাতা জেলা সভাপতি দায়িত্বভার পান। সংগঠনের মুখপত্র যুবশক্তি পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে রবীন দেবের পরে ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। 
মানব মুখার্জি সিপিআই(এম)’র কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য হন ১৯৮৬ সালে, ১৯৯৮ সালে তিনি পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য হন এবং কলকাতা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যও হয়েছিলেন ২০১৮ সালে, তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি বেশিদিন সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। 
তাঁর সংসদীয় রাজনৈতিক জীবনও বর্ণময়। কৃষ্ণপদ ঘোষের মৃত্যুর পরে ১৯৮৭ সাল থেকে কলকাতার বেলেঘাটা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে মানব মুখার্জি পরপর পাঁচবার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হন ১৯৯৬ সালে, ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি মন্ত্রী ছিলেন। বিভিন্ন পর্যায়ে যুব কল্যাণ দপ্তর, পর্যটন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবেশ দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। 
ছাত্র-যুব আন্দোলন থেকে সরকারের মন্ত্রক পরিচালনা সবেতেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন মানব মুখার্জি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকেই সুবক্তা হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন মানব মুখার্জি। যুব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় ভাষণের পাশাপাশি কলমের জোরও প্রমাণ করেছিলেন তিনি। যুবশক্তি পত্রিকা সম্পাদনায় এবং পত্রিকায় লেখায় তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। ১৯৮৭ সালে দার্জিলিঙ তখন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসে উত্তপ্ত। যুব আন্দোলনের নেতা হিসাবে মানব মুখার্জি, রবীন দেব, অশোক ভট্টাচার্য, রবি চম্পটির সঙ্গে দার্জিলিঙের বিজনবাড়িতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অল্পের জন্য বেঁচে ফিরে আসার পরে যুবশক্তিতে মানব মুখার্জি লিখেছিলেন, ‘সাক্ষী থাকবে কাঞ্চনজঙ্ঘা-কারা লড়ছে দেশের জন্য’। সেই শিরোনাম রাজ্যব্যাপী দেওয়াল লিখনে পরিণত হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন বর্ণবৈষম্যের অবসানের পরে প্রথম নির্বাচন হচ্ছে তখন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ডেমোক্রেটিক ইয়ুথের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে মানব মুখার্জি জোহানেসবার্গ গিয়েছিলেন। সাংবাদিকের ভঙ্গিতে তিনি তখন গণশক্তিতে বিবরণ লিখেছিলেন। পরের বছর বই হিসাবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘একটি জাতির জন্ম: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’। এভাবেই তাঁর নানা সময়ে নানা লেখা বহুল প্রশংসিত হয়েছে। অনুপ্রবেশের বাহানা তুলে রাজনৈতিক অপপ্রচার ভাঙতে ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ: রাজনীতি এবং বাস্তবতা’ লিখেছিলেন ১৯৯৫ সালে। আরএসএস-বিজেপি’র উত্থান সম্ভাবনা দেখে ২০১১ সালেই লিখেছিলেন ‘ফ্যাসিবাদের উত্থান : একটি পুনর্পাঠ’। চীন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটাতে তিনি যুগ্ম সম্পাদনা করেছিলেন ‘চীন: একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন’। তাঁর লেখা রাজনৈতিক উপন্যাস ‘কাঠের ঘোড়ার সওয়ার’ও জনপ্রিয় হয়েছিল। 
কমরেড মানব মুখার্জি যখন যুব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন রাজ্যের উত্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবিলা, কেন্দ্রের বৈষম্যের মোকাবিলা করে রাজ্যে শিল্পায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থরক্ষা ইত্যাদি ছিল গুরুতর চ্যালেঞ্জ। হলদিয়া পেট্রোকেম, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদির জন্য বাংলার ছাত্র-যুব সমাজকে সোচ্চার করে তোলার নেতৃত্বে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন মানব মুখার্জি। সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিপদ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়েও মানব মুখার্জি অনায়াস দক্ষতায় ভাষণ দিতেন ও লিখতেন। সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের ভাঙনের পরেও বাংলার যুবসমাজকে বামপন্থায় শাণিত রাখতে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম হয়ে থেকে যাবে কমরেড মানব মুখার্জির নাম।  
 

Comments :0

Login to leave a comment