Md Salim

মহম্মদ সেলিমের সাক্ষাৎকার

কলকাতা লোকসভা ২০২৪

রাজ্যে লড়াই দু-পক্ষের নয়, তিন পক্ষের
এখন নতুন ধরনের মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে রাজ্যে, একদিকে তৃণমূল-বিজেপি, অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি। অনেকদিন ধরে এই বুনন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি আমরা। এবারের নির্বাচন পুরোপুরি ত্রিমুখী লড়াই। মানুষ সেটা বুঝছেন, সাক্ষাৎকারে জানালেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সাক্ষাৎকার নিয়ছেন প্রসূন ভট্টাচার্য।

প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল এবং বিজেপি’র মেরুকরণ ভাঙার ডাক দিয়েছিল সিপিআই(এম)। এবারের লোকসভা নির্বাচনে সেটা কতটা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন?
মহম্মদ সেলিম: পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে অনেকটাই সেটা ভাঙতে শুরু করেছিল। তারপরে গ্রাম জেগেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, চোর ধরো জেলে ভরো বলেছে। এখন তো নতুন ধরনের মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে, একদিকে তৃণমূল-বিজেপি, অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি। অনেকদিন ধরে এই বুনন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি আমরা। ১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে এই প্রথম বাংলায় লোকসভা নির্বাচনে আসন সমঝোতা হয়েছে বাম শক্তির বাইরের শক্তির সঙ্গেও। কংগ্রেস এসেছে, পাহাড়ের হামরো পার্টি এসেছে, বিভিন্ন আদিবাসী জনজাতি সংগঠন এসেছে, সবাই যে ভোটে লড়ছে তা নয়। কিন্তু এরা সবাই বিজেপি এবং তৃণমূল বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে। এখন এটা আর দ্বিমুখী লড়াই নেই, মিলনধর্মী সংস্কৃতি এবং বৈচিত্রকে রক্ষা করতে এবারের নির্বাচন এখন পুরোপুরি ত্রিমুখী লড়াই। 
প্রশ্ন: যদি নির্বাচনী আসন সমঝোতার নিরিখে বিচার করি, আপনাদের প্রচেষ্টা কতটা সফল হয়েছে ?
সেলিম: একশো শতাংশ বলতে পারব না, কিন্তু ৪২টা আসনেই সমঝোতা হয়েছে। কেউ কেউ বেসুরো গাইতে পারে, সম্ভবত কোনও বাধ্যবাধকতা থাকায়। বিজেপি তৃণমূল বিরোধী অবস্থান সবাই নিতে পারে না, সেটা যদি নিতে পারত তাহলে আইএসএফ’ও আমাদের সঙ্গে থাকত, তাহলে আরও ভালো হতো। 
প্রশ্ন: কিন্তু কিছু বামপন্থী এখনও বলছে কেবল বিজেপি বিরোধিতাই জরুরি, তারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচার করতে চায় না।
সেলিম: যারা ভোটের আগে এসব বলছে, তারা এরাজ্যে বিজেপি বিরোধী আন্দোলন কী করেছে? এরাজ্যে মমতা ব্যানার্জির হাত ধরে বিজেপি’র যখন উত্থান ঘটছিল তখন মাও জে দঙের কসম খাওয়া কিংবা এই সব আগ মার্কা বিপ্লবীরা বিজেপি বিরোধী কোন অবস্থানটা নিয়েছিল? এদের টিকি বাঁধা আছে, এরা বিজেপি বিরোধীও নয়, তৃণমূল বিরোধীও নয়। ভোটের আগে আইপ্যাকের মতো ভাড়ায় খাটে। 
প্রশ্ন: এতে কি শেষপর্যন্ত বিজেপি’রই সুবিধা হয়ে যাবে না? 
সেলিম: বিজেপি বিরোধী অবস্থান দৃঢ় করতে হলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে এবং সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। ছোট শয়তান বড় শয়তান আলাদা হয় না, সব শয়তানের বিরোধী হতে হবে, সব অন্যায়ের বিরোধী হতে হবে। তৃণমূল বিরোধিতা না করে শুধু মাত্র বিজেপি বিরোধী অবস্থান নিলে সেটা আদতে বিজেপি’কে মদত দেয়। কারণ একটা বড় অংশের মানুষ বিজেপি’র দিকে গেছে তৃণমূল বিরোধী অবস্থানের কারণে। তাহলে আমরা কেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে চুপ থেকে মানুষকে বিজেপি’র দিকে ঠেলে দেবো? লড়াইটা দুর্নীতি দুষ্কৃতীর যোগের বিরুদ্ধে, এই লড়াইতে যোগী অমিত শাহ মোদীর বিরুদ্ধে যেমন বলতে হবে, পিসি ভাইপোর বিরুদ্ধেও তেমনই বলতে হবে। তৃণমূল সম্পর্কে নীরব থাকলে তৃণমূল-বিজেপি মিলিতভাবে যে মেরুকরণ করেছিল, সেটাকেই পুনরায় মজবুত করা হবে। রাজ্যে বেকারি বড় সমস্যা, কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছে না, সারের কালোবাজারি হচ্ছে, বিদ্যুতের দাম, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলতে হলে ইলেকটোরাল বন্ড, দুর্নীতি এবং অর্থনীতির বিরুদ্ধেও কথা বলতে হবে, যেটা বিজেপি’র মতো তৃণমূলও এখানে কার্যকর করছে। 
প্রশ্ন: আপনি জনজীবনের সমস্যার কথা তুলছেন। এর জন্য আপনি বাংলার বুকে বামপন্থার পুনরুত্থান ঘটিয়ে বামপন্থী বিকল্পের রূপায়ণের কথাও বলেছেন। রাজ্যের রাজনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আশা করছেন?
সেলিম: প্রথমেই এই দুর্নীতি ও দুষ্কৃতীরাজ শেষ করতে হবে। সমস্ত দুর্নীতিলব্ধ অর্থ উদ্ধার করতে হবে, মানুষের অধিকার ফেরাতে হবে। গণতান্ত্রিক চেতনা ও অধিকার সম্প্রসারণ করতে হবে। যতো মিথ্যা মামলা হয়েছে সেগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। পুলিশকে নিরপেক্ষ করতে হবে, পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। পুলিশ নেতানেত্রীদের পাহারা দেওয়ার জন্য নয়, মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে, দাঙ্গা রুখতে, আইন বলবৎ করতে হবে পুলিশকে। খেলা হবে বলে টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে। দলবদলের এই অপসংস্কৃতি বাংলায় ছিল না, এটা বন্ধ করতে হবে। রাজ্যের শিক্ষা পরিকাঠামো ও বাতাবরণ নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবা মজবুত করতে হবে, তলায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যন্ত পরিকাঠামো ঠিক করতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষায় হাজার হাজার পদ শূন্য। সেগুলো পূরণ করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত পদ্ধতিতে, সংরক্ষণের নিয়ম মেনে এসসি- এসটি’দের অধিকার রক্ষা করে। সবরকম ভাতা দুর্নীতিমুক্তভাবে দিতে হবে, তাহলে দ্বিগুণ মানুষকে আরও বেশি পরিমাণে দেওয়া সম্ভব হবে। এর সঙ্গে মানুষকে রোজগেরে করে তুলতে হবে। বাংলার ছেলেমেয়েরা শুধু কর্মপ্রার্থী হবে না, কর্মোদ্যোগী হবে, দক্ষতা মেধা দিয়ে দেশকে নতুন পথে দেখাবে। বাংলার পুনর্জাগরণ মানে আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফিরে যেতে বলছি না, কিন্তু নবজাগরণের ধারাকে আরও পরিপক্ব করতে হবে, যে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে তা বন্ধ করে। রাজনীতিতে বিকৃতি এসেছে বলেই সংস্কৃতিতে বিকৃতি এসেছে। 
প্রশ্ন: আপনি তো যৌবনের কাছে সোনালি অধ্যায়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। এই সব দাবিতে বাংলার যৌবনকে আমরা রাস্তায় নেমে আলোড়ন ফেলতে দেখেছি সাম্প্রতিককালেও। কিন্তু নির্বাচনে তার প্রভাব কি পড়বে?
সেলিম: অবশ্যই। সিপিআই(এম)’র নির্বাচনী স্লোগান কী? হোক রুটি রুজি। ন্যায়, গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা, তার সঙ্গে রুটি রুজির প্রশ্ন। যেভাবে আয় কমেছে, মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, তাতে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। মানুষের গড় সঞ্চয় কমে গেছে। তাহলে নতুন প্রজন্মের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য কী থাকবে? অথচ মানব সভ্যতাকে এগতে গেলে সঞ্চয় রাখতে হয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। প্রকৃতি পরিবেশে কী রেখে যাচ্ছি? 
প্রশ্ন: আপনি নিজে মুর্শিদাবাদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন লোকসভা নির্বাচনে। নির্বাচনী প্রচারে কেমন সাড়া পাচ্ছেন, কী অভিজ্ঞতা হচ্ছে আপনার? 
সেলিম: প্রথমত, আমি মনে করি, লড়াইটা ময়দানে নেমে সামনে থেকে করতে হয়। দ্বিতীয়ত, একঝাঁক নতুন কর্মকুশলী খেটে খাওয়া মানুষের থেকে উঠে আসাদের প্রার্থী করেছি আমরা। যারা শুধু জনগণের প্রতিনিধিত্বই করবে না, রাজ্যের হক দিল্লি থেকে কেড়ে নিয়ে আসতে পারবে, সেটা একশো দিনের কাজের কিংবা আবাস যোজনার টাকাই হোক, দুর্নীতির টাকা উদ্ধারই হোক। তার সঙ্গে আমাদের রাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় প্রকল্প, কারখানা, ভাঙন রোধ, সেচ, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের পরিকাঠামো নিয়ে আসতে হবে। একাজ আমরা অতীতে করেছি, এখন নতুন যৌবনের ঢেউ সেই কাজ আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। এতে প্রবীণদেরও সঙ্গে থাকতে হয়েছে পথ চলায় সহায়তা করার জন্য। তৃতীয়ত, মুর্শিদাবাদ একসময়ে বাংলা বিহার ওড়িশার রাজধানী ছিল। পলাশীর যুদ্ধের আগে মুর্শিদাবাদের গ্রাম ইউরোপের গ্রামের থেকে এগিয়ে ছিল অর্থনৈতিক এবং কারিগরি দিক থেকে। এখন সেখানে কাজ নেই, পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যেতে হচ্ছে। উন্নয়ন করতে হলে উত্তর দক্ষিণে, পূর্ব পশ্চিমে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী দৃঢ় করে, যোগাযোগ, বাণিজ্য আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সীমান্তে স্মাগলিং হচ্ছে, বাণিজ্য হচ্ছে না। শাসকদলের নেতারা স্মাগলিংয়ের টাকা খাচ্ছে। স্বচ্ছভাবে সীমান্ত বাণিজ্য হলে মানুষ, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। আমরা মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারি উৎসব চালু করেছিলাম, দুই বাংলার পর্যটনকে উৎসাহ দিতে। এখন মেলা খেলা হচ্ছে, হাজারদুয়ারি উৎসব বন্ধ হয়ে গেছে। 
প্রশ্ন: অনেকে সন্দেহ করে কংগ্রেসের ভোট বামফ্রন্টে যাবে না, বামফ্রন্টের ভোট কংগ্রেসে যাবে না। মুর্শিদাবাদে তো বামফ্রন্টের পাশাপাশি কংগ্রেসেরও ভিত্তি আছে, সেখানে আপনার অভিজ্ঞতা কী বলছে? 
সেলিম: এসব কিছু মিথ আছে। সেটাকে আঘাত করে ভাঙতে হয়। বিজেপি তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষদের ঐক্য বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে শুধু নেতাদের কাছাকাছি এলে হবে না, আমাদের কর্মী সমর্থক নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যেও ঐক্যের ভাব গড়ে তুলতে হবে। মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে করেছেন যে আমি যদি প্রার্থী হই তাহলে সেটা আরও সাবলীলভাবে করা সম্ভব হবে। সেটা দেখাও যাচ্ছে, মানুষ হইহই করে নেমেছে। এটা শুধু মুর্শিদাবাদে নয়, সারা রাজ্যেই হাওয়া উঠেছে, এটা ঝড়ে পরিণত হবে। 
প্রশ্ন: কিন্তু বিগত নির্বাচনগুলির বিশেষত পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় যা দেখা গেছে, তাতে মানুষ কি নির্বাচন কমিশন আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভরসায় অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন? 
সেলিম: আগেও বলেছিলাম কোনও কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যের বাহিনী নয়, মানুষের বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেই প্রতিরোধ স্পৃহা দেখা গেছে। যেখানে স্থানীয় মানুষের ঢল নেমেছে, সেখানে সন্ত্রাস রোখা গিয়েছে। মানুষের রায় যারা ভাঙতে গিয়েছিল সেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও সাম্প্রদায়িক শক্তির মনে ভয় ঢুকেছে, তারা খানিকটা গুটিয়েছে। 
প্রশ্ন: মাসল পাওয়ার পাশাপাশি এই সময়ে মানি পাওয়ারেরও ব্যবহার করছে শাসকদল। টাকার স্রোতে জনমত কেনা রোখা যাবে? 
সেলিম: প্রতিদিন ওরা মন্ত্রী এমএলএ কেনাবেচা করছে, তাই বলে মানুষকে কেনা যায়? মূল্যবোধ কাজ করে মানুষের মধ্যে। সাগরদিঘিতে মানুষ প্রতিরোধ করেছিল টাকা বিলির, টাকা বিলি করতে গেলে সন্দেশখালির মানুষ তৃণমূলকে এমন তাড়া করেছিল যে লঞ্চে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। এই মেজাজটাকে ধরে রাখতে হবে!
 

Comments :0

Login to leave a comment