১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাস। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হলো, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাসে একটি কালো দিন।
তখন আমি দিল্লিতে ছিলাম। এরাজ্যে কয়েকটি জায়গাতেও সাম্প্রদায়িক উসকানির চেষ্টা চালায় দুষ্কৃতীরা। কিছুদিনের মধ্যে দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরি। পার্টির নির্দেশেই তখন সাংসদ হিসাবে আমি এবং বেলেঘাটার বিধায়ক কমরেড মানব মুখার্জি বেলেঘাটা-নারকেলডাঙার কয়েকটি এলাকায় যাই। দুষ্কৃতীরা কিছু বাড়িঘর ভাঙচুর করেছিল। আমরা এলাকায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলি। যে কোনও ধরনের প্ররোচনা ঠেকাতে পার্টিকর্মীরাও সেসময় রাস্তাতেই ছিলেন।
আমি আর মানব মুখার্জি এলাকায় ঘুরছি, সেসময় এক পুলিশ আধিকারিক এলেন। তাঁর কাছে ততক্ষণে খবর এসেছে সাংসদ আর বিধায়ক এলাকায় রয়েছেন। আমাদের কাছে এসে তিনি প্রথমে মানব মুখার্জির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘মিস্টার মহম্মদ সেলিম, আমরা সর্বদা নজরদারি রাখছি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’’। এরপর আমার কাছে এসে বলেন, ‘‘মিস্টার মুখার্জি, আমরা রয়েছি, চিন্তা নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে’’। আসলে তখন তো আর অত টিভি, মিডিয়া ছিল না। ওই পুলিশ আধিকারিক সাংসদ আর বিধায়কের নাম শুনেছেন কেবল, কিন্তু মুখে চেনেন না।
ওরকম গম্ভীর পরিস্থিতি, হাসাও যাচ্ছে না। তখনই মানব মুখার্জি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘সেলিম, পুলিশের ভুল ভাঙানোর দরকার নেই। বরং এই ভুল-বোঝাবুঝি থেকেই উনি আমাদের আলাদা করে যদি কিছু বলেন তাহলে আমাদের কাছেও অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে’’। মানব মুখার্জি এমনই।
৪৪ বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, পার্টি, লড়াই আন্দোলনের মিশেলেই সেই সম্পর্ক, একই সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কও। এমন একজন কমরেড যার সঙ্গে অনেক আড্ডা, আলোচনা প্রাণ খুলে করতে পারতাম। ওঁর চিন্তা-ভাবনা, জ্ঞানের পরিধিও ছিল অনেকটা বিস্তৃত। মার্কসীয় দর্শন, রাজনৈতিক পড়াশুনোর বাইরে শিল্প, সংস্কৃতি, কবিতা, সাহিত্য অনেকটা বড়ো ছিল ওঁর জগৎ। লেখার হাতও ছিল তেমনই, শক্তিশালী কলম, তীক্ষ্ণ যুক্তি, আবেগের মিশ্রণ। লিখতোও দ্রুত, হাতের লেখাও ছিল তারিফ করার মতো। আবার বিতর্ক যখন করত, তখন যেন স্টেনগান চলত, যাতে যুক্তিবোধই ছিল প্রধান।
আটের দশকের মাঝামাঝি সময়। মণ্ডল কমিশন, জাতপাতের বেড়াজাল, ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি। তখন বেশিরভাগ সময় ছাত্র-যুবদের সমাবেশে আমি আর মানব মুখার্জি একসঙ্গে যেতাম। তখন অনেকে বলত ‘মানব-সেলিম’ জুটি। আমরা নিজেরা ঠিক করে নিয়েছিলাম দু’জনে দু’ভাবে বক্তব্য রাখব। হিন্দু পুনরুত্থানবাদী তত্ত্বকে মূলত খণ্ডন করে অসাধারণ বক্তৃতা করতেন, বাগ্মী ছিলেন। আমি মূলত বলতাম মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে। এই বোঝাপড়া নিয়েই আমরা একসঙ্গে কত সভা, সমাবেশ করেছি, অনেকটা ক্রিকেটে দুটো এন্ডে ব্যাটিংয়ের মতো নিখুঁত বোঝাপড়ায়।
মনে পড়ছে ওঁর দক্ষিণ আফ্রিকার সফর, সেখান থেকে অসাধারণ সব কপি লিখে পাঠাতেন ‘গণশক্তি’তেও। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী শাসন কাঠামো ভেঙে পড়েছে। সে সময় ডিওয়াইএফআই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হিসাবে মানব মুখার্জিকে বিশ্ব যুব ফেডারেশনের তরফে পর্যবেক্ষক হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রত্যক্ষ করতে পাঠানো হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ ওঁর কলমের মাধ্যমে ‘গণশক্তি’তে তুলে ধরেছিলেন। যে কাজের জন্য পাঠানো হয়েছিল তার পাশাপাশি যেন ‘গণশক্তি’র ‘সাংবাদিক’ হয়েই উনি তখন রিপোর্ট পাঠাতেন। পরে ফিরে বই লিখলেন- ‘একটি জাতির জন্ম, এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’। আমরা জানতাম এটা ওঁর পক্ষেই সম্ভব। ছাত্র-যুব আন্দোলনে কর্মীদের কাছেও বইটি জনপ্রিয় হয়েছিল। তারপর আন্তর্জাতিক যুব উৎসব। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যের পরে ডিওয়াইএফআই মুখ্য সংগঠক হিসেবে কিউবায় আন্তর্জাতিক যুব উৎসব। সে সময়েও মানব মুখার্জি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
নয়ের দশকে সোভিয়েতের পতন, পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিপর্যয়, এদেশে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির যাত্রা শুরু— এক কঠিন, জটিল সময়। সেই সময়েই নতুন উদ্যমে ছাত্র-যুবদের সংগঠিত করার কাজেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। ভারসাম্য সাম্রাজ্যবাদের দিকে হেলে পড়া, হাজারো প্রশ্ন। সেই সংশয়ের মধ্যেই নতুনভাবে ভেবে, সৃষ্টিশীল উদ্যোগে, বৈচিত্রময় কর্মসূচির মাধ্যমে যুব সংগঠনকে পরিস্থিতির উপযোগী করে তুলতেও ভূমিকা নিয়েছিলেন কমরেড মানব মুখার্জি।
আরেকটি কথা উল্লেখ করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ছাত্র-যুব সংগঠকদের মধ্যে অনেকে প্রশ্ন করতেন আমাদের মধ্যে কে বয়সে বড়? আসলে আমরা একসঙ্গে ছাত্র আন্দোলন করেছিলাম। তারপর আমি যুব আন্দোলনে। মানব মুখার্জি তখনও ছাত্র আন্দোলনে, তারপর যুব আন্দোলনে। ফলে সংগঠনের নিরিখে আমাকে ওঁর থেকে বড় ভাবতো বাকিরা। তা নিয়ে আমাদের মধ্যেও হাসিঠাট্টা চলত। আমরা তখন বোঝাপড়ায় আসি, যেহেতু মানব মুখার্জি আমার থেকে দু’বছরের বড়, তাই যখন ব্যক্তিগত পরিসরে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া হতো তখন ‘মানবদা’ বলতাম, আর সভা, সমাবেশে মঞ্চে থাকলে মানব মুখার্জি বলেই সম্বোধন করতাম!
আমাদের দেশ, রাজ্যে নতুন এক পরিস্থিতি। দুই শাসকদলের জনবিরোধী নীতি। এরাজ্যে তৃণমূলের মতো দল সরকারে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তের দাপট। তার মধ্যেই চলছে ধারাবাহিক প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আন্দোলন, মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে, ভয় কাটছে। নতুন প্রজন্মের মুখ আসছে আমাদের কর্মসূচিতে, তরুণ প্রজন্ম নেতৃত্ব দিচ্ছে লড়াইয়ে। মানুষের আস্থা অর্জনের লড়াই প্রতিদিন জারি রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে গতকাল পর্যন্ত আমাদের আশা ছিল লড়াকু মেজাজেই মানব মুখার্জি ফিরে আসবেন আমাদের মধ্যে। অসুস্থ শরীরেও চেষ্টা করতেন নানান কর্মসূচিতে থাকার। শারীরিক অসুস্থতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই চালিয়েছেন। একইসঙ্গে তাঁর স্ত্রী ঈশিতা মুখার্জিও সেই লড়াই লড়েছেন, ওঁকে ফের লড়াইয়ের ময়দানেই ফিরিয়ে আনতে চেষ্টার কসুর করেননি। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করেই মানব মুখার্জি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন মঙ্গলবার সকালে।
অসংখ্য কমরেড, ছাত্র-যুব আন্দোলনের সেই সময়ের সংগঠক, প্রাক্তনীরা, ওঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী সকলকেই সমবেদনা জানাচ্ছি সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তরফে।
একজন কমরেড, একজন বন্ধু, একজন বাগ্মী, সংগঠক তাত্ত্বিক, একজন সাথীকে হারালাম আমরা।
কমরেড মানব মুখার্জি লাল সেলাম। কমরেড মানব মুখার্জি অমর রহে।
Comments :0