নতুনপাতা | রঙ উৎসবের গল্প
কুট্টুসের হোলি
সাঁঝবাতি পাল
খাটের নিচের থেকে আবিরের ব্যাগটা টেনে ঠোঙা খুলে টুকাই দেখা আরম্ভ করলো কি কি রং আছে তাতে। বেচারা কুট্টুস খাবার ভেবে ছুটে এলো,বেশ কয়েকবার শুঁকতেই টুকাই বলে উঠলো "ধুর বোকা, এটা রং, খেতে নেই, আজ কি বলতো?"ওর ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিতে দিতে টুকাই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো উত্তরের অপেক্ষায়।"তুই কিছুই জানিস না, আজ দোল!আর এই যে আবির, আজ কাউকে দেখলেই রং মাখাতে হয় বুঝলি?"চকচকে দুটো চোখ নিয়ে কুঁ কুঁ করলো কুট্টুস। তাতেই বেশ খুশি হয়ে ওর নাকে নাক ঘষে টুকাই উঠে পড়লো। নাহ দেরি হয়ে যাচ্ছে, এবার বেরোতে হবে। এতদিন হোলি মানে কি খুব একটা জানতো না বছর দশের টুকাই।শুধু এই সময়টা বেশ ভাল্লাগে তার,বাড়ির নীলমনি গাছে ফুল এসে কেমন নীল হয়ে যায়। বিকেলে কেমন হাওয়া দেয়।এবছরই যেন টের পাচ্ছে দোলের আনন্দ... পাশের বাড়ির বাবানদা ব্যাপারটা বুঝিয়েছে। পাড়ার মাঠের উদ্দেশ্যে টুকাই বেরিয়ে পড়লো তার আবিরের থলে নিয়ে। যাওয়ার আগে হাঁক দিলো "মা, আমি যাই ?" মা খুব জানতেন এবারে আটকে রাখা যাবে না। অগত্যা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বললেন "যাও,তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে কিন্তু টুকাই" কুট্টুস ও টুকাই এর পেছনে পেছনে বেরোলো ঘর থেকে। স্কুল থেকে ফেরার সময় কুট্টুসকে যেদিন প্রথম রাস্তায় দেখেছিলো টুকাই, প্রচন্ড বায়না করেছিল ঘর নিয়ে আসার জন্য। বাবা বাধ্য হন ছেলের আবদার মেটাতে। সেই থেকে কোনো দামি জাতের কুকুর না হলেও আদর আপ্যায়নের অভাব হয়নি তার।আর টুকাই ও পেয়েছে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী।বাইরে এসেই হঠাৎ ভীষণ আনন্দ হলো টুকাই এর। আকাশটা পুরো নীল, রোদে চকচক করছে শালগাছের নতুন সবুজ পাতাগুলো। চিৎকার করে বলে উঠলো "আজকের দিনটা কি সুন্দর তাই না কুট্টুস?তুই যা আমি এবার হোলি খেলবো, মাকে বলে দিবি আমি পৌঁছে গেছি মাঠে"
প্রায় দুঘন্টা পর ভুত হয়ে ফিরল টুকাই।
স্নান করে তারপর গরম ভাতের সামনে বসে রং খেলার খুঁটিনাটি বিবরণ দিতে দিতে টুকাই এর হঠাৎ মনে পড়লো, একি কুট্টুস কই ?! মাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।ওর থালাটাই ভাত দিয়ে ডাক দিল "কুট্টুস",দেখাদেখি টুকাই ও খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লো, এতক্ষনে তো ওর বাড়ি চলে আসার কথা। দুপুর হয়েছে। আজ দোল...এটা ভেবে মা এর মনটা কেমন কু ডাকলো। রাস্তায় বেরিয়ে দুজনেই ডাকাডাকি শুরু করলো। পাশের বাড়ির কাকিমা বলতে পারলো না কিছুই। কোথায় খুঁজবে কিছুই বুঝতে পারছে না ।মাঠ পর্যন্ত গিয়ে মা বললো "নাহ, বাড়ি চল, এতক্ষণে চলেও আসতে পারে, নয়তো বাবাকে আবার পাঠাবো।" ফিরতে ফিরতে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল টুকাই এর।কি হবে যদি বাবাও না খুঁজে পায়.. হঠাৎ কুই কুই আওয়াজ পেলো সে । ল্যাম্পপোস্ট এর পাশে রাখা সবুজ ডাস্টবিন। তার পেছনের অন্ধকারে যেন চকচক করছে দুটো চোখ। এগিয়ে গেল টুকাই।ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে কুট্টুস। আলতো করে ধরে বাইরে আনতেই টুকাই দেখলো ওর সারা গা ভিজে, ঘাড়ের পাশে রোম গুলো নেই, কে যেন রং ছুঁড়ে ওর সাদা রোমগুলো লাল করে দিয়েছে। কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না টুকাই এর মুখ দিয়ে। শুধু ছলছল করছে দুটো চোখ হঠাৎ কোলে তুলতেই চিৎকার করে উঠলো "একিরে তোর তো মাথায় লেগেছে!" মা এর ও চোখ গেল, ডান চোখের একটু ওপরে একটা ক্ষত, বেশ গভীর। মা বললো "পাড়ার ছেলেদেরই কাজ" আর আটকাতে পারলো না টুকাই ওর ঘাড় জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদা শুরু করলো, "ওরা কি করেছে বল না কুট্টুস, খুব লেগেছে না তোর.. অনেক ব্যথা করছে?! "
মা চাইলেও বলতে পারছেনা কিছুই। বসন্তের বিকেলে একইরকম বাতাস বইছে তখন। সূর্যের আভায় লাল হয়ে উঠেছে আকাশ। আর ল্যামপোস্টের নিচে কুট্টুসকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে টুকাই বলে চলেছে “ আজকের দিনটা একদম ভালো নয়, তাই না রে কুট্টুস, একদম ভালো নয়!”
নতুন বন্ধু
উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ন
ঠিকানা- জঙ্গলমহল
Comments :0