RBI employees Association

জনকল্যাণে সরকারি খরচ বাধ্যতামূলক করা দরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্মী সভায় পট্টনায়েক

কলকাতা

সরকারি কৃপা দেখাতে নয়, মানুষকে অধিকার দিতে জনকল্যাণে সরকারি ব্যয় বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক। শুক্রবার কলকাতায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, গরিবকে কৃপা করার মনোভাব ছেড়ে সরকার মর্যাদা দিক। কাজ, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেনশন, সব মানুষ যাতে এই পাঁচটি সুযোগ পেতে পারে তার জন্য এগুলিকে অর্থনৈতিক অধিকার বলে মান্যতা দেওয়া হোক। তাহলে সব সরকারকে বাধ্যতামূলক খরচ করতে হবে এর জন্য। 
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন, কলকাতা’র শতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে এদিন এই সভা হয়েছে বিবাদী বাগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ভবনে। দেশের অন্যতম প্রাচীন এই সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রভাত পট্টনায়েক ছাড়াও ভাষণ দেন কেরালার প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা। সাম্প্রতিক অতীতে কেরালার এলডিএফ সরকার কীভাবে বন্যা, ঝড়, নিপা ভাইরাস এবং তারপরে কোভিড মোকাবিলায় সাফল্য পেয়েছে তার উল্লেখ করে শৈলজা বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের আর্থিক সাহায্য দেয়নি, কিন্তু আমরা মানুষকে রক্ষা করতে যত বেশি সম্ভব শিক্ষা স্বাস্থ্যক্ষেত্র সহ সামাজিক পরিকাঠামো বাড়িয়েছি। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, এসব ক্ষেত্রে মূলধনী বিনিয়োগ নিরাশ করে না। কেরালার মানুষকে আমরা বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পেরেছি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেওয়ার বদলে আমাদের বারবার খরচ কমাতে বলছে। 


এই প্রসঙ্গেই কেরালা সরকারের মনোভাবকে সমর্থন করে প্রভাত পট্টনায়েক বলেছেন, জনকল্যাণকে কৃপা করার মনোভাবে না দেখে সরকারের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব হিসাবে দেখতে হবে। এর জন্য ট্রেড ইউনিয়ন ও গণসংগঠনগুলির লড়াই করা দরকার। 
অধ্যাপক পট্টনায়েক বলেন, বর্তমান পুঁজিবাদ দুনিয়াজুড়ে এমন সঙ্কটে পড়েছে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কখনো দেখা যায়নি। ভারতেও স্বাধীনতার পরে এমন সঙ্কট দেখা যায়নি। ভারতের অর্থনীতিকে যতোই ‘বিকাশমান’ বলে গর্ব করা হোক, নয়া উদারনীতির প্রথম দুই দশকের তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, ভারতে ক্ষুধা ও দারিদ্র দুটোই বেড়েছে।  নয়া উদারনীতি এমন একটি ব্যবস্থা কায়েম করে যাতে পুঁজি সীমানা ছাড়িয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে অবাধে যেতে পারে। এটা পুঁজির জন্য সুখকর বন্দোবস্ত। বৃহৎ পুঁজির এই সুখের ব্যবস্থা করে দিতে গিয়ে কৃষি অলাভজনক হয়ে গিয়েছে, শহরে বেকারি বেড়েছে। এই বেকার বাহিনী পুঁজিপতিদের সুবিধা করে দিয়েছে শ্রমিকদের সঙ্গে দর কষাকষিতে, তারা কম মজুরি দিয়ে মুনাফা বাড়াচ্ছে। কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ায় বাজারে চাহিদা কমছে, মন্দার সঙ্কট থেকে পুঁজিবাদ বের হতে পারছে না। 
পুঁজির বিশ্বায়িত বাজারে পুঁজি টানতে আমেরিকা কীভাবে সুদের হার বাড়িয়ে ভারতীয় মুদ্রা রুপির অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে তার উল্লেখও করেছেন প্রভাত পট্টনায়েক। তিনি বলেছেন, রুপির দাম স্থিতিশীল করতে গিয়ে ভারতের বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডার ক্রমশ কমছে। শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান বাংলাদেশও এই একই কারণে বিপদে পড়েছে।
এই অবস্থায় রেহাই পাওয়ার রাস্তা দেখাতে অধ্যাপক পট্টনায়েক বলেছেন, জনকল্যাণকে বাধ্যতামূলক করে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। তার জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে? গুরুত্বপূর্ণ দু’টি উপায় হলো, সমাজের ওপরতলার ধনী ১ শতাংশের ওপরে ২ শতাংশ সম্পত্তি কর বসানো হোক এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ হস্তান্তরের ওপরে এক তৃতীয়াংশ কর আরোপ করা হোক। পুঁজিবাদের যুক্তিতেই এটা গ্রহণযোগ্য পথ, জাপান এবং আমেরিকাতে এটা বসানোও হয়েছে। ভারতে কেন হবে না? 
এর অন্যথা হলে দেশে যে নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে সেই সতর্কবার্তা দিয়ে প্রভাত পট্টনায়েক বলেছেন, চিরাচরিত (ক্লাসিকাল) ফ্যাসিবাদ মাথা তুলেছিল গত শতাব্দীর তিনের দশকে এমনই অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতে। তখন জাপান এবং জার্মানির ফ্যাসিবাদীরা সামরিকীকরণের মাধ্যমে বেকারি কমিয়ে মন্দা মোকাবিলা করেছিল। এখন কিন্তু নয়া ফ্যাসিবাদের সামনে সেই সুযোগ নেই। তাই তারা বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে হাত মিলিয়ে, স্বৈরশাসনে প্রতিবাদ দমন করে, মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ও কাল্পনিক শত্রু দাগিয়ে দিয়ে সমাজের আলোচ্য বিষয় পালটে দিচ্ছে, সমস্যাকে আড়ালে রেখে দিচ্ছে। 


এদিনের সভায় সভাপতিত্ব করে অল ইন্ডিয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সমীর ঘোষ সংগঠনের শতবর্ষের সংগ্রামী ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করেছেন এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে গচ্ছিত সম্পদের ওপরে সঠিক নজরদারির জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বশাসিত ভূমিকা রক্ষার জন্য এখনও সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ড অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠন করা হোক। সরকার যেন বোর্ডকে দিয়ে ইচ্ছামতো কাজ করিয়ে নিতে না পারে।
অনুষ্ঠানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মীরা এবং ব্যাঙ্ক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ভাষণ দিয়েছেন অল ইন্ডিয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অজিত সুবেদার, অল ইন্ডিয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি অরুণ সমাদ্দার।
 

Comments :0

Login to leave a comment