STORY — BICHANA / MUKTADHARA

অণুগল্প — সমাজ বসু / মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

STORY  BICHANA  MUKTADHARA

অণুগল্প 
বিছানা
সমাজ বসু 

 

   — কি গো, ছেলের হাতে বানানো তোষক আর বালিশে শুয়ে যে তোমার ঘুম ভাঙতেই চায় না। সকালে হাতের কাজ সারতে সারতেই কথাগুলো বললেন, কণিকা দেবী। সুজয়ের বাবার উদ্দেশ্যে। 
   — সেই মাস চারেক আগে ছেলেটা বাড়ির বিছানাগুলোর দৈন্যদশা দেখে বানিয়ে দিয়ে গেল, আজো কেমন নতুন লাগে গিন্নি। বিজয় বণিক আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললেন।
   — কতবার বললাম, কাজের জায়গায় সারাক্ষণ এইসব করতে হয়, বাড়িতেও আবার কেন করবি। কিনে নিয়ে আয়। কে কার কথা শোনে। কাজে যাবার আগের দিনও অনেক রাত অবধি তোষকটা সেলাই করে তবেই শুয়েছে। করুণা দেবীর গলায় ছেলের জন্য একরাশ কষ্ট ঝরে পড়ে। 
   — ছেলেটার চিন্তায় চিন্তায় দিন কয়েক হল রাতে ঘুমোতে পারি না, গিন্নি। তাই ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে যায় । 
   — সুজু ফোনে জানাল, গতকাল ভোরে নাকি মীরাট থেকে রওনা দিয়েছে। জগদীশপুরের ও একাই। খুবভয় হচ্ছে । পারবে তো এতটা পথ হেঁটে আসতে ?
   — চিন্তা কোর না, সঙ্গে আরো অনেকেই আছে । ও আমাকে বলেছে । বিজয়বাবু স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন।
   — সরকার থেকে ওদের ঘরে ফেরার কোন ব্যবস্থা করেনি গো ? করুণা দেবীর কৌতুহলী জিজ্ঞাসা। 
   — জানি না, কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে এটা বেশ বুঝতে পারছি, ওরা এখন সবার চক্ষুশূল। অথচ দেশ নির্মাণের কাজে প্রধান কারিগর । আজ ওরাই ব্রাত্য । বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হয় কাল ভোর হয়ে যাবে।


       সুজয় বণিকের মত জগদীশপুর আর তার আশপাশের গ্রাম থেকে জনা দশেক ছেলে লেপ, তোষক আর বালিশ তৈরির কাজ নিয়ে আজ প্রায় বছর চার হলো মীরাটের অস্থায়ী বাসিন্দা । বছরের দশ মাসের কাজের ছুটিতে ওরা নিয়োজিত । বাকি দু মাসের এক মাস শুধু সবেতন ছুটি ছাড়া আর কোন বাড়তি সুযোগ। সুবিধা নেই ।
       যাই হোক তবু দিন মাস একরকম কেটে যাচ্ছিল । হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল । কী যে এক মারণ রোগ সারা দেশকে স্তব্ধ করে দিল । সুজয়দের কাজকর্ম সব শিকেয় উঠল । ওদের ঘরে ফেরার কথা জানিয়ে দিয়েছে মালিক জনার্দন পান্ডে । তবু তার দয়ার শরীর । দিন সাতেক সুজয়দের ভরন পোষণ জুগিয়েছেন । কিন্তু তিনিও নিরুপায় । বসিয়ে খাওয়ানোর সামর্থ তার নেই । অগত্যা সুজয়দের বাড়ির পথ ধরতে হয়েছে ।


       দিনের আলো ক্রমশ নিভে আসছে । পাখিদের ঘরে ফেরার উৎসবে আজ যেন সুজয়রাও সামিল হয়েছে । ক্লান্ত অবসন্ন চোখেও যেন স্বপ্নের জোনাকিরা জ্বলছে - আর নিভছে। আর সেই আধো আলো ছায়ায় ওরা পায়ে পা মেলাচ্ছে । এত ক্লান্ত। এত অবসাদ কোন দিন ওদের ঘিরে ধরেনি। রাত জেগে কাজের শেষেও কাহিল হয়নি । কিন্তু আজ শ্রান্তি যেন ওদের পায়ে বেড়ি ফেলে রেখেছে। রেললাইন থেকে আকাশে চোখ রাখে । একেবারে ঝরঝরে আকাশে কাস্তে চাঁদের কাছে তারাগুলো মেঘ-বালিশে মাথা রেখে যেন গল্প শুনছে। এমন একটা মেঘ-বালিশ আর একটা নীল চাদরের বড় প্রয়োজন। একরাশ ঘুম যে নেমে আসছে ওদের চোখে। মনে হল কে যেন বিছানা পেতে রেখেছে । অনেক লম্বা বিছানা । সেই ওদের জগদীশপুর অবধি । পাশাপাশি শুয়ে পড়ল । কিছুক্ষণের জন্য ওদের মনে হল, তোষক আর বালিশের তুলো যেন লোহার মত শক্ত । এত শক্ত তুলোয় তো ওরা কাজ করে না। কার হাতে তৈরি কে জানে ? এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি । ঝমঝম শব্দ আর জোড়ালো আলোয় জড়ানো ছিন্নভিন্ন সে ঘুম পরদিন নিজের নিজের বাড়িতে তাদের তৈরি বিছানায় শুয়েও ভাঙেনি ।

 

 

 

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment