STORY — KHAGESWAR DAS / NATUNPATA

গল্প — পক্ষীবিশারদ / নতুনপাতা

ছোটদের বিভাগ

STORY  KHAGESWAR DAS  NATUNPATA

গল্প

পক্ষীবিশারদ 
খগেশ্বর দাস


 
           ঠিক নদী নয়, নদীর কিছুটা ছাড়া অংশ, বাঁকা, অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ। এতদঞ্চলের বিখ্যাত পক্ষিনিবাস। ট্রেন থেকে নেমে 
মালতীপুর। মালতীপুর বাজার পেরিয়ে দু-কিলো মিটার দূরে । দু-পাশে চাষের জমি , সরু আলপথ পেরিয়ে তারপর মজা নদীর দেখা পাওয়া যায় । গ্রামটিকে সবাই বলে পাখিগ্রাম। নদীর দু-পাশে সবুজ চাষের জমি, অদূরে দুদিকে ছোটো দুটি গ্রাম। মাঝে মাঝে  দু -একটা লোক খেতে কাজ করে । দুপুরে দু-পাশের গ্রামের নারী -পুরুষেরা ঘাটে স্নান করে। বাদবাকি পরিবেশ একান্ত নির্জন। দুপুরের পরে নদী শুনসান , শুধুই পাখার আওয়াজ,পাখিদের বিচিত্র কলকাকলি।  হুইসলিং ডাক, মালার্ড, ইউরেশিয়ান পিনটেল, রেড ক্র্যাস্টেড প্রোচার্ড, আইবিস, শামুকখোল, ইগলেট, হেরণ আরও কত কত দেশি এবং বিদেশি পাখি।  বহু বহু দূরের  দেশ থেকে প্রতিবছর শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা এখানে আসে।  দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে কত কত পক্ষীপ্রেমিক। তারা আসে পাখি দেখতে। সারাদিন পাখি দেখে, পাখি গোনে, ছবি তোলে, বিকেলে কেউ কেউ ফিরে চলে যায়। কেউ আবার রাত্রি যাপন করে, পরদিন সকালে আবার পাখির ছবি তোলা। 


       এখানে গ্রামের মানুষ বড়োই গরিব, এতদিন চাষবাস আর মাছধরা ছিল এদের জীবিকা। এই পাখি গ্রামেরই  গরিব জেলে পরিবারের ছেলে মাধব। মজা নদীতে সে সারাদিন নৌকো চালায়। পাখিবাবুরা তার নৌকোয় চড়ে পাখি দেখে, পাখির নাম বলে, কঠিন কঠিন কত ইংরেজি নাম।  অত নাম কী করে যে তারা মন রাখে, মাধব অবাক হয়ে যায়। মাধবতো গ্রামের পাঠশালায় শুধু ফোর ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তার সঙ্গে আরও যারা নৌকো চালায় তারাও তেমন লেখাপড়া জানে না। হাঁস, বক, দোয়েল, ফিঙে, কাক, শালিক, মাছরাঙা, চিল, চ্যাগা, বজ, ইগল, কাদাখোঁচা, শামুকখোল, বেনেবউ এইক-টা পাখির নাম তারা জানে। সেগুলো বাংলা নাম, দেশি পাখির। প্রতিবছর কত কত পাখিবাবুরা পাখি দেখতে আসে, মাধব তাদের সঙ্গে নৌকো চালায়, কত কত পাখির নাম শোনে, ইংরেজি নাম , সেও নতুন নতুন নাম মনে রাখতে চায়। উচ্চারণ ভুল হলেও তার শেখার আগ্রহে কোনো খামতি নেই। নৌকো চালাতে চালাতে কয়েকজন পাখিবাবুর সঙ্গে তার খুব ভাব হয়েছে, তারাও মাধবকে খুব ভালোবাসেন, প্রশ্রয় দেন। তাদের বদন্যতায় মাধবও এখন অনেক পাখির নাম জানে, অনেক পাখি সেও চেনে। মাধবকে গ্রামের লোকেরা ও তার সঙ্গীরা ব্যঙ্গ করে বলে, পক্ষীবিশারদ। 
      মাধবের তাতে কোনো রাগ নেই। পাখি দেখতে, পাখি চিনতে তার খুব ভালো লাগে। আগে সে পাখিদের বাংলা নামই শুধু কিছুকিছু জানতো। এখন 
পাখিবাবুদের সঙ্গে থেকে থেকে, মজা নদীর প্রায় সব পাখির বাংলা ও ইংরেজি নাম তার জানা। শুধু পাখিদের  নামই নয়, বিভিন্ন পাখির স্বভাব চরিত্রও তার জানা হয়ে গেছে। কখন কোন্ পখি আসবে, তাদের পছন্দের আবাস কোথায়, কখন তারা ডিম দেবে, বাচ্চা হবে সব তার জানা। 
        কয়েকবছর আগেও এমন ছিল না। গ্রামের লোকেরা নদী  থাকে পাখি মেরে খেতো, ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করত।গ্রামের মাস্টারমশাই, অনিল বাবুইতো সকলকে শেখালেন, এভাবে পাখি মারলে একদিন পৃথিবী থেকে পাখিরা লুপ্ত হযে যাবে। এটা ভারী অন্যায়। তিনিই শেখালেন, নদীতে  আরও আরও পাখি এলে খুলে যাবে বিকল্প আয়ের পথ। বহু লোক পাখি দেখতে, পাখির ছবি তুলতে এখানে আসবে। তৈরি হবে পক্ষীনিবাস, পর্যটন কেন্দ্র। সেই থেকে গড়ে উঠেছে টুরিস্ট লজ, রাত্রিবাসের ব্যবস্থা । গড়ে উঠেছে সমবায়, নৌকো ভ্রমণ, নৌকোয় ছবি তোলার নির্দিষ্ট রেটও ঠিক হয়েছে। এখন প্রতিবছর শীতকালে বহু পর্যটক আসে, গরিব মানুষগুলোর কিছু কিছু রোজগার হয়। মাধব তখন থেকেই এভাবে নৌকো চলিয়ে চালিয়ে, পাখিবাবুদের সঙ্গে থেকে, পাখি চিনতে শিখেছে।

 
         গেল বছর শীতকালে মজা নদীতে, পাখির ছবি তুলতে এসেছিলেন এক বিদেশি সাহেব। তিনি পরপর দুদিন এখানে থেকে ছবি তুলেছিলেন। দুদিনই তিনি মাধবের নৌকোয় চড়ে ছবি তুলছেন। মাধব তাঁকে পাখিগুলোর বাংলা নাম সব বলে দিয়েছিল। সে সাহেবকে ভালো ভালো পাখির জায়গায় নিয়ে গিয়ে অনেক পাখির ছবি তুলতে সাহায্য করেছিল। মাধবের পাখি চেনার জ্ঞান দেখে, সহেব তো খুব খুশি, সাহেবের সঙ্গে মাধবের খুব ভাব হয়ে গেল। সেই দুদিন সহেবের সঙ্গে মাধবের ভালোই কেটেছিল। সাহেব  ছিলেন খুব দরাজ। তিনি মাধবকে ভালোবেসে, ফিরে যাওয়ার সময় তাঁর সাহেবি টুপি আর একটি ব্রাউন টি-শার্ট উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আরও একটা কাজ করেছেন, তার 
নোটবইয়ে মাধবের নাম ও ঠিকানা লিখে নিয়েছিলেন। 
       তারপর প্রায় এক বছর হতে চলল সামনে শীতকাল পাখি মরশুম। দুপুরবেলা মাধব তার ডিঙি নৌকোর তদারকি করছিল। এমনসময় ডাকপিওন হন্তদন্ত হয়ে এল মাধবের খোঁজে। কী ব্যাপার ! মাধবের নমে বিদেশ থেকে পার্সেল এসেছে। সকলেই অবাক, ডাকপিওন নিজেও। তড়িঘড়ি পার্সেল খুলে দেখা গেল, পাখির ছবি ও নাম ছাপানো ঝকঝকে সুন্দর একখানা বই, কোনো এক সাহেবের লেখা, সাথে আছে মাধবেরও নাম। বইখানি হাতে পেয়ে বেচারা মাধব, স্থির চোখে নিজের নামের দিকে চেয়ে রইল শুধু।

Comments :0

Login to leave a comment