STORY — SOURAV DUTTA / MUKTADHARA - 11 September

গল্প — তিমির বিলাস / মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

STORY  SOURAV DUTTA  MUKTADHARA - 11 September

গল্প মুক্তধারা
 

তিমির বিলাস

সৌ র ভ  দ ত্ত

পায়রাডিঙির মাঠ টপকে দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে অরিন্দম দেখল দুটো বাচ্ছা ছেলে সাইকেলে যেতে যেতে বলাবলি করছে – চল চল; আজ ইণ্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ। বে! কারেন্ট এলেই টিভিতে খেলা চাইলে দিতে হবে। কয়েকদিন ধরে পাড়ায় লোডশেডিং চলছে।

নিশুতি রাত। পাশের পাড়া থেকে সংকীর্তনের সুর ভেসে আসছে। মানুষের হঠাৎ এত ধর্মে মতি হল কেন, কে জানে!মাঝে মধ্যেই দেখি পাড়ায় পাড়ায় পরিবারের মহিলাদের সাথে ও বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরাও রসকলি করে খঞ্জনি নিয়ে হরিকীর্তনে মজেছে –"ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে…"

অরিন্দমের বাবার হাঁপের টানটা ইদানিং খুব বেড়েছে।খোল-কর্ত্তালের আওয়াজে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।তার উপর নতুন উৎপাত বলতে
লোডশেডিং। বাড়ির পাশের নদীতে কারা যেন দূষিত দুর্গন্ধযুক্ত জল ছেড়েছে। বিশ্রী দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগে।কানের কাছে মশার ভোঁ ভোঁ আওয়াজ; বৃদ্ধ মানুষটি ছটফট করে।কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাওয়া সেরে ইনহেলার নিয়ে বিছানায় শুয়েছিল। অনেকক্ষণ হয়ে গেল কারেন্ট আসেনি। কিছুদিন আগেই অরিন্দমের মা মারা গেছে। মা থাকলেও না হয় হাওয়া বাতাস করত। সে বাইরের দরজার খিলটা খুলে পায়চারি করতে থাকে। ঝাঁকে ঝাঁকে মশা ছেঁকে ধরছে। ফোনের আলোটা জ্বেলে আশপাশের বনজঙ্গল ও কাছের বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে থাকে।দূরে দেবদারু গাছের ঝোপে শিয়ালের চোখ জ্বলে। ঝিঁঝি ডাকে।

পরদিন বাজারে কাগজের দোকানের শ্যামবাবুর সাথে কথা বলতে বলতে নিয়মিত লোডশেডিং এর প্রসঙ্গ উঠতেই শ্যামবাবু বললেন – "জানো তো ওই যে পুজো কমিটিগুলোকে ৭৫ হাজার টাকা ৭৫ শতাংশ ইলেকট্রিক বিল মকুব করার হবে অনুপ্রেরণার অনুপ্রেরণায় – এই না হলে উন্নয়ন। এটা তারই একটা মহড়া বোধহয়। রাজ্যটা একবারে উচ্ছন্নে গেল হে গোবর্ধন। "সামনের বেঞ্চে কাগজ পড়তে থাকা বে-পাড়ার এক ব্যক্তি কাগজের পাতা থেকে চোখ তুলে বলেন ঠিক বলেছেন মশাই – "দেখবেন এবার পুজোয় প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে জোরকদমে হুকিং শুরু হবে। আর এই অদ্ভুত বিদ্যুৎ বিভ্রাট বাড়বে। মানুষও নাজেহাল হবে।"

পাশ থেকে মলয়বাবু বলে উঠলেন – "দ্যাখো গিয়ে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সব কয়লা শেষ হয়ে গেল কিনা! যেভাবে দুপুর-রাতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।!
আর এদিকে ভারত না ইণ্ডিয়া? এইসব নিয়ে দেশ মেতেছে…দ্যাখো যদি কিছু হয়…

সব জায়গায় একই কথা।গরমে নাভিশ্বাস ওঠা মানুষের গল্প ঝিম মেরে আছে রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানগুলোতে। স্টিলের প্লেটে করে আড্ডায় চা নিয়ে আসে কেওড়া পাড়ার মহাদেব।কথায় কথায় সে বলে ওঠে – "এটা কি ম্যানমেড লোডশেডিং ভাই!" চা-এ চুমুক দিয়ে সবাই খলখল করে হেসে ওঠে। গোবর্ধন পেশায় প্রাইভেট টিউটর। বাড়িতে গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য হাজার দুয়েক বই জমিয়ে লাইব্রেরি করেছে। অনেক ছেলেমেয়ে সেখানে বইয়ের সন্ধানে যায়। গতমাসে গোবর্ধনের বিল এসেছে দশ হাজার পাঁচশো একাশি টাকা।একে অসুস্থ বাবা। তার ওষুধপত্রের জন্য অনেক টাকার যোগান দরকার। তার উপর বাড়ির বিদ্যুৎ বিল এতটাকা বিশ্বাসই করতে পারে না সে!সেদিন যে লোকটি মিটারের রিডিং নিতে এসেছিল সেও রীতিমতো অবাক হয়েছিল। এসি ছাড়া এত বিল ভাবা যায় না! এই অস্বাভাবিক বিলের অভিযোগ সে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ দপ্তরে। তাকে বলা হয়–" পুরো বিষয়টা ভেরিফিকেশন করতে দিন কুড়ি লাগবে"। কিন্তু আজ প্রায় চল্লিশ দিন হয়ে গেল কোন সুরাহা হল না। ওর পরিচিত জেলা পরিষদের বিদ্যুৎ দপ্তরের কর্মাধ্যক্ষ দাদাকে ধরেও কিছু হয়নি। পাড়ায় অনেকে কানঘুষো করছে সপ্তাহ খানেক নাকি এরকমই লোডশেডিং চলবে! টি.ভি, ফ্রিজ, এসি না থাকা সত্ত্বেও মিটারের এরকম বেয়াড়া আচরণ সে মানতে পারে না। প্রতিদিন প্রায় ত্রিশ ইউনিটের বেশি বিল উঠছে।মাথা জট পাকিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই বিষয়টার কুলকিনারা করতে পারছে না। অথচ টিউশন পড়ানো বা বিভিন্ন কাজে দিনের বেশিরভাগ সময়ই সে বাড়ির বাইরে থাকে। তবু কেন যে এত মাত্রাছাড়া বিল বোঝা খুব মুশকিল!

কেউ বলে–"ওটা ভুতুড়ে বিল! এ রাজ্যে ভূতের-ও ভবিষ্যত আছে জানেন তো মশাই? কারণ ভূতেও ভোট দেয়। কত শত ভূত পুরো ভূষণ্ডির মাঠ উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। নন্দনে ঝাক্কাস ‘ও লাভলী’! সিনেমা চলছে। লোক টিকিট কেটে এইসব দেখতেও যাচ্ছে। একদা বঙ্গসংস্কৃতির বাঘা বাঘা পীঠস্থানগুলো সব পশুখামার হয়ে গেল। "

পাড়ার পুজো-পার্বণে–"টুম্পা সোনা.." গান বাজছে।কি দিনকাল এল মাইরি! শিক্ষক দিবসে পাড়ার বেচা পেল ছিক্ষারত্ন। রবিঠাকুরের লেখা জাতীয় সঙ্গীতের অনুপ্রেরণায় নাকি ওই একই সুরে নতুন একটা গান বাঁধা হবে। আহ্লাদে আটখানা বাঙালির–বং কানেকশন। আসলে সরকার যখন ব্রেকফেল করে তখন গোটা রাজ্যে বিদ্যুৎসরবরাহও ব্রেকডাউন হয়।আমরা সবাই যেন অন্ধকারের যাত্রী…।

ইতিমধ্যে মহানন্দ কখন ঘাপটি মরে চা'দোকানের বেঞ্চে এসে বসে ফুট কেটে উঠলে – " জানিস তো অরিন-ন্দ-ম আমার মনে হয় ঐ প্রজ্ঞান আর বিক্রমের চাঁদের দেশের অন্ধকারে ঘুমতে যাওয়ার মতন সেই জ্ঞানেশ্বরী কাণ্ডের পর আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরাও লোডশেডিং-এর অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়েছে – কি বলিস…"।

কাগজের দোকানে বসে অরিন্দম যেন শুনতে পায় গলদঘর্ম বাবার হাঁপের শব্দ। বালিশের পাশে রাখা ইনহেলারটা ঠক্ করে পড়ে যায় মাটিতে – "আমি আর সহ্য করতে পারছি না খোকা। হাতপাখাটা টেনে একটু জোরে বাতাস কর।"

দোকানের বেঞ্চের নিচে নামিয়ে রাখা বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে তাড়িঘড়ি দোকান থেকে উঠে বাড়ির দিকে রহনা দেয় সে….এরমধ্যে দোকানেও লোডশেডিং। সর্বত্র অন্ধকারের রাজত্ব।

 

 

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment