Sengol

রাজদণ্ড দেখা দিল মোদীর মিথ্যা দণ্ডরূপে

জাতীয়

নতুন সংসদ ভবনে ‘সেঙ্গোল’ স্থাপন নিয়ে বিজেপি’র তোলা প্রচারের ফানুস ফেটেই গেছে। এই ‘রাজদণ্ড’ নিয়ে যে গল্প ফেঁদেছিল সরকার এবং শাসক দল তা-ও অসত্য বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। একের পর এক ইতিহাসবিদ এবং গবেষক তথ্যপ্রমাণ উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, সেঙ্গোলের সঙ্গে ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের’ কোনও সম্পর্কই নেই। 
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং পরে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সেঙ্গোল সম্পর্কিত কাহিনি পেশ করেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে মাউন্টব্যাটন একটি প্রতীকী জিনিস খুঁজছিলেন। নেহরুকে তা বলায় নেহরু চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর পরামর্শ নেন। রাজাগোপালাচারী তখন তামিল চোল রাজাদের প্রাচীন রাজদণ্ড হস্তান্তরের প্রথার উল্লেখ করেন। সেইমতো চেন্নাইয়ের অলঙ্কার নির্মাতাদের দিয়ে একটি অলঙ্কারখচিত দণ্ড বানানো হয়। তামিলনাডুর তাঞ্জাভুরের মঠের পুরোহিতরা বিশেষ বিমানে তা দিল্লিতে নিয়ে আসেন। তা মাউন্টব্যাটনকে দেওয়া হয়। তিনি পুরোহিতদের উপস্থিতিতে ভাবী প্রধানমন্ত্রী নেহরুর বাসভবনে ওই দণ্ড তুলে দিয়ে ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’ করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট এই ঘটনা ঘটে বলে দাবি করা হয়। এটিই ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘প্রতীক’ বলে শাহরা দাবি করেন। 
এখন দেখা যাচ্ছে, এই গল্পে অজস্র ফাঁক। প্রথমত, ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনও আনুষ্ঠানিক ঘটনা ঘটেইনি। ব্রিটিশ সংসদের ভারতের স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭-এ ভারত স্বাধীনতা পেয়ে যায়। ওই আইনে রাজার সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল ১৮ জুলাই। ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর নির্ধারিত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, অধীনম মঠের পুরোহিতরা ওই দণ্ড উপহার দিয়েছিলেন নেহরুকে, তাঁর বাসভবনে। ব্যক্তিগত ও বেসরকারি অনুষ্ঠানে। মাউন্টব্যাটনের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্কই নেই। সেই সময়ের সংবাদপত্রের বিবরণে এই অনুষ্ঠানের বিশদ বর্ণনা রয়েছে। ১৯৪৭-র ২৫ আগস্ট ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে এই সন্ন্যাসীদের আসা ও নেহরুকে বাড়ি গিয়ে দণ্ড উপহার দেবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে লেখা রয়েছে শৈব সন্ন্যাসীরা তাঁদের প্রথা মেনে এই উপহার দিয়েছিলেন। অমিত শাহের দাবি মতো ‘গঙ্গার জল’ দিয়ে শুদ্ধ করা হয়নি, তাঞ্জোর থেকে আনা নদীর জলই ছেটানো হয়েছিল। নেহরুর মতো নিরীশ্বরবাদীও এই ধর্মীয় উপহার গ্রহণ করেছিলেন তদানীন্তন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনও ঘটনাই ঘটেনি। এই রকম অজস্র উপহার নেহরু তখন পেয়েছিলেন। বস্তুত, ওই সময়ে প্রকাশিত সব সংবাদপত্রেই লেখা হয়েছে, মঠের পুরোহিতরা নেহরুকে ব্যক্তিগত উপহার দিয়েছিলেন। 
রাজাগোপালচারীর পৌত্র ও তাঁর জীবনীকার রাজমোহন গান্ধী এদিন এক টেলিভিশন চ্যানেলকে জানিয়েছেন, সেঙ্গোলের গল্পে রাজাগোপালাচারীর সংশ্রবের কথা আমি জীবনে শুনিনি। এই গল্প আমার মতো অনেকের কাছেই নতুন। নেহরুর বাড়িতে যদি ধর্মীয় নেতারা ওই উপহার দিয়েও থাকেন তাহলে বেসরকারি এক ব্যক্তির বাসভবনে এক ব্যক্তিগত উপহার দেবার ঘটনা তা। কোনও সরকারি পদাধিকারী প্রকাশ্যে কোনও ধর্মীয় প্রথাকে মদত দিতে পারেন না। তা সংবিধান সম্মত নয়। সংসদের মধ্যে ওই দণ্ড এনে রাখাও সংবিধান সম্মত পদক্ষেপ হবে কি? 
অমিত শাহ তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে সেখা যাচ্ছে ধর্মীয় নেতারা নেহরুকে চাদর দিচ্ছেন, রাজাজী এবং নেহরু ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে একাধিক বার আলোচনা করছেন। রাজমোহন গান্ধী একটি মারাত্মক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ওই ভিডিও আসলে অভিনয়, এখনকার অভিনেতারা অভিনয় করেছেন। অথচ কোথাও তা উল্লেখ করা নেই। ভবিষ্যতে হয়ত ওই দৃশ্যকেই ঐতিহাসিক সত্য বলে ভাবতে পারেন কেউ। অভিনয়কে তথ্যচিত্র বলে ধরে নেওয়া হতে পারে। এটি নিন্দনীয়। 
নেহরুর রচনার সম্পাদক ইতিহাসবিদ মাধবন কে পালাত বলেছেন, যদি মাউন্টব্যাটন সত্যিই ওই দণ্ড তুলে দিতেন তাহলে ব্রিটিশরা তা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করত। রানির দণ্ডের মতোই এই প্রতীককেই তারা ব্যবহার করত। ব্রিটিশরা এ নিয়ে কোনও কথা বলেনি, কোনও ছবিও নেই। তাছাড়া ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের হাত থেকে এমন কোনও ক্ষমতার প্রতীক নেহরু গ্রহণ করতেন না। নেহরু ক্ষমতা নিতেন সংবিধান ও গণপরিষদ থেকে, ভাইসরয়ের হাত থেকে নয়। ওই মঠের প্রধানের কি গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ব ছিল যে এমন একটি ‘হস্তান্তর’ তিনি করতে পারেন? কোনো সরকারী তথ্যই নেই। কোথাও কিছু নেই। 
তাদের দাবির সমর্থনে একগুচ্ছ লেখা ও কাগজপত্র সরকারই দিয়েছিল সংবাদমাধ্যমকে। তার মধ্যে ‘হোয়াটসঅ্যাপ হিস্টরি’ বলে একটি ব্লগ পোস্ট রয়েছে। সেখানে বিশিষ্ট তামিল লেখক জয়ামোহন এই গোটা কল্পিত কাহিনিকেই কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন, সোশাল মিডিয়ায় আসা গল্পকে ব্যবহার করা হচ্ছে। 
সেঙ্গোল কাহিনির ভিত্তিহীন দাবি একের পর এক প্রমাণে নস্যাৎ হওয়ায় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এদিন জয়রাম রমেশ বলেছেন, সেই হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষ্য দিয়েই নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন হতে চলেছে, এ কি কোনও বিস্ময়ের কথা? বিজেপি-আরএসএস’র বিকৃতকারীরা আরও একবার উন্মোচিত হলো। তাদের সর্বোচ্চ দাবি, ন্যূনতম প্রমাণ। কোথাও কোনো প্রমাণ নেই মাউন্টব্যাটন, রাজাজী, নেহরু এই দণ্ডকে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক বলে দেখছেন। এই মর্মে সব দাবি, এককথায় ফালতু। কিছু লোকের মস্তিষ্কপ্রসূত এই গল্প হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে, এখন মিডিয়ায় ঢাক পিটিয়েরা তা ছড়াচ্ছে। এই দণ্ডকে মোদী ও তাঁর ঢাক পিটিয়েরা ব্যবহার করছে তামিলনাডুতে তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যের কথা মাথায় রেখে। এই বাহিনীর কাজই হলো বিকৃত লক্ষ্যের জন্য তথ্যের বিকৃতি ঘটানো। আসল প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রপতিকে এই অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো না কেন? 
অমিত শাহ নিজেও শুক্রবার তাঁর কথা ঘুরিয়েছেন। মাউন্টব্যাটন উধাও, ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিও উধাও। শাহ এদিন বলেছেন, কংগ্রেস দল ভারতীয় ঐতিহ্যকে এত ঘৃণা করে কেন? পণ্ডিত নেহরুকে তামিলনাডুর শৈব মঠের তরফে একটি পবিত্র সেঙ্গোল দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তা জাদুঘরে রেখে দেওয়া হলো? বিজেপি’র সভাপতি জে পি নাড্ডাও এই প্রসঙ্গে নেহরু-গান্ধী পরিবারকে আক্রমণ করেছেন কিন্তু পুরানো গল্প আরও একবার বলতে সাহস পাননি। 
বস্তুত, এই রাজদণ্ড স্থাপনের রীতির মধ্যে দিয়ে হিন্দুত্ববাদকেও ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। হিন্দু ধর্মীয় প্রথার মাধ্যমে বার্তাও দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে, এখন প্রবল সমালোচনার মুখে ‘সর্ব ধর্মের’ একটি অনুষ্ঠান করা হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।

Comments :0

Login to leave a comment