SILICOSIS KILLING WORKERS

পাথর ফুসফুস, সে যন্ত্রণা
চোখে দেখা যায় না,
দেখে না সরকারও

রাজ্য

SILICOSIS KILLING WORKERS

অনিন্দ্য হাজরা

গোড়ায় অল্প কাশি আর জ্বর। বোঝাই যায় না কত বড় রোগ বেঁধেছে শরীরে। আর শেষে একবারে তাজা জোয়ানের চেহারা কঙ্কালের মতো শুকিয়ে যায়।

সমস্ত পেশাগত রোগের মধ্যে অন্যতম ভয়ঙ্কর হল নিউমোকোনিওসিস। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফুসফুসে নানা ধরণের ধুলোর আস্তরণ জমে পাথর হয়ে যায়। তারফলে প্রচন্ড নিঃশ্বাসের কষ্টের সঙ্গে হানা দেয় অবধারিত মৃত্যু। মর্মান্তিক এই পরিণতি জানাচ্ছেন আক্রান্ত, নিহতদের পরিজনরা। 

নিউমোকোনিওসিসের একটি ধরণ হল সিলিকোসিস। ফুসফুসে সিলিকা বা বালি, পাথরের গুড়ো, সিমেন্টের গুড়ো, ইঁটের গুড়ো ইত্যাদি জমলে তাকে সিলিকোসিস বলে। নিউমোকোনিওসিসের ভয়ঙ্করতম রূপ হল সিলিকোসিস। 

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, সিলিকা সমৃদ্ধ নানা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের অন্ততপক্ষে ৩০ শতাংশ এই রোগের শিকার। ২০১১ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সংসদে একটি রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই সময় ১ কোটি শ্রমিক বিপদসীমায় ছিলেন। স্বাভাবিক নিয়মেই, বর্তমান সময়ে সেই সংখ্যা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। 

বুধবার কলকাতার ওয়াই চ্যানেলে অবস্থান বিক্ষোভ হয়েছে সিলিকোসিসে আক্রান্ত শ্রমিকদের একাধিক দাবিতে। বিক্ষোভ শেষে একটি প্রতিনিধি দল শ্রম দপ্তরে ডেপুটেশন দেয়। শ্রমিক সংগঠন সিআইটিইউ’র সঙ্গে বিজ্ঞান আন্দোলন, স্বাস্থ্য সংগঠন একত্রে গড়েছে সমন্বয় কমিটি। সিলিকোসিস ও পেশাগত রোগ বিরোধী এই কোঅর্ডিনেশন কমিটির ডাকেই হয়েছে বিক্ষোভ। দীর্ঘদিন আন্দোলন চললেও সরকারের সক্রিয়তার মাত্রা খুবই সীমিত। বলছেন সংগঠকরা। 

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে এবং ঝাড়খন্ডে বহু পাথর খাদান রয়েছে। এই খাদান ব্যবস্থাটার প্রায় গোটাটাই বেআইনি। আইনের আওতার বাইরে থাকায় সেখানে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে শ্রম আইন লাগু হয় না। নেই ন্যূনতম শ্রমিক নিরাপত্তা। 

সিআইটিইউ’র বক্তব্য, ফুসফুসে পাথরের গুঁড়ো যাওয়া আটকাতে পাথর শিল্পের প্রত্যেক শ্রমিককে মুখোশ দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু স্রেফ গামছা কিংবা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে কাজ করতে বাধ্য হন শ্রমিকরা। অসুস্থ হয়ে পড়লে কাজ থেকে বসিয়ে দেন মালিক। মেলে না কানাকড়ি সাহায্য। 

এক কথায় মধ্যযুগীয় শোষণ ব্যবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ। 

সিলিকোসিস আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলির বক্তব্য, সিলিকোসিস শ্রমিকদের একটা বড় অংশ থাকেন উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, ক্যানিং, মিনাখা, দেগঙ্গা, সন্দেশখালির মতো জায়গায়। এই এলাকার যুবদের একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক। কাজের খোঁজে পাথর খাদানে গিয়ে উপস্থিত হন তাঁরা। বাড়ি ফেরেন মারণ রোগ নিয়ে। গত ৫-৭ বছর ধরে আক্রান্ত শ্রমিকদের কিছুটা হলেও সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছে। দুই ২৪ পরগনার নানা প্রশাসনিক দপ্তরে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। জারি রয়েছে আইনি লড়াইও। 

লড়াই আরও জোরদার করার জন্যই সিআইটিইউ, এআইটিইউসি, আইএনটিইউসি, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, স্টুডেন্টস হেলথ হোম, অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিসেস ডক্টরস সহ ১০টি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন, ৪টি স্বাস্থ্য সংগঠন এবং আরও কিছু গণসংগঠন মিলে গড়ে তুলেছে সিলিকোসিস ও অন্যান্য পেশাগত রোগ বিরোধী কো-অর্ডিনেশন কমিটি। এদিন এই কমিটিই দিয়েছে ডেপুটেশন।

ডেপুটেশনে পেশাগত রোগে আক্রান্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, মৃত ও আক্রান্ত শ্রমিকদের পরিবারের জন্য মাসিক ভাতা ও পেনশন চালু করা, তাঁদের সু-চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা, অবৈধ পাথর খাদানগুলিতে বৈধতা দিয়ে আইনের আওতায় নিয়ে আসা, এবং খাদান মালিকদের শ্রমিক সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে বাধ্য করা সহ ১০ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। 

এদিনের বিক্ষোভ সমাবেশে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব ছাড়াও আক্রান্ত শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বক্তব্য রাখেন। 

তেমনই একজন মরিয়ম বিবি। গোয়ালদহ গ্রামের এই মহিলার ছেলে আফতারুল মোল্লা সিলিকোসিস আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। মরিয়ম বিবি বলছেন, ‘‘প্রথমে বোঝা যায় না যে রোগী সিলিকোসিস আক্রান্ত। প্রথমে খুসখুসে কাশির সঙ্গে জ্বর আসে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে টিবির ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ওষুধে কাজ হয় না। তারপর অসুস্থতা বাড়ে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় রোগীর। খাবার খেতে পারে না। একসময় শরীর শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে যায়। এবং তারপর মৃত্যু।’’ 

মরিয়ম বিবি জানাচ্ছেন, তাঁর আরও এক পুত্র সিলিকোসিস আক্রান্ত। সরকারের তরফে কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনও সহযোগিতা করা হয়নি। 

মরিয়ম বিবির সরাসরি অভিযোগ, ‘‘গ্রামের ছেলেরা পেটের টানে কাঁধে গামছা মুড়ি দিয়ে কাজে যাচ্ছে, এবং রোগ বাঁধিয়ে ঘরে ফিরছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের পানে চাইছেন না। মুখ্যমন্ত্রী কেবল বড়লোক এবং বড় জমিদারদের পানে চেয়ে রয়েছেন। গরিব বলে আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন না।’’ 

মরিয়ম বিবির জানিয়েছেন, তাঁদের গোয়ালদহ গ্রামের ৪৫ জন যুবক সিলিকোসিস আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। মৃত্যুর সময় তাঁদের শরীরে চামড়া ছাড়া কিছু অবশিষ্ট ছিল না। পরিবারের সদস্যদের সামান্য জমিটুকুও বিক্রি করে দিতে হয়েছে গ্রামের মানুষকে। 

মরিয়ম জানাচ্ছেন, ‘‘আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য দৈনিক প্রায় পাঁচ হাজার টাকা খরচ। গরিব মানুষ কোথা থেকে সেই খরচ চালাবে? তারপর ছেলে গুলো শেষ সময়ে খেতে পারে না। যা-ই খায় বমি হয়ে যায়। সেই যন্ত্রণা চোখে দেখা যায় না।’’ 

মরিয়ম বিবি ছাড়াও বক্তব্য রাখেন আজিজুল পাইক, হাপিজুল মোল্লা, সাইদুল পাইক এবং রাজ্জাক মোল্লা। তাঁদের সবার কাহিনীই প্রায় এক। 

একই জবানে উঠে এল জীবনতলা ক্যানিংয়ের আনারুল মোল্লার গলাতেও। তাঁর বাবা ২০১৬ সালে সিলিকোসিস আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। 

আনারুলের কথায়, ‘‘বাবা আমার কোলে মাথা রেখে ছটফট করে মারা গিয়েছে। শেষ বেলায় কথা বলতে পারত না। কেবল বুকে চাপড় মেরে দেখাত কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তারবাবু নিঃশ্বাসের জন্য বুকে ফুটো করে দিয়েছিল। সেই যন্ত্রণা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।’’ 

গ্রাফিক্স: মনীষ দেব

Comments :0

Login to leave a comment