Smart Meter

কেন্দ্রের শর্ত মেনে স্মার্ট মিটার বসাতে গ্রাহকদের চিঠি পাঠাচ্ছে রাজ্য

রাজ্য

 চড়া দরে আগাম বিদ্যুৎ কেনার শর্তকে গোপন রেখে প্রিপেড স্মার্ট বসানোর জন্য গ্রাহকদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে রাজ্য সরকার!

কোথাও বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বাড়ি, বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে স্মার্ট মিটার বসিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করার চিঠি। কোথাও আবার স্মার্ট মিটার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে মাইক নিয়ে প্রচারে নামানো হয়েছে দপ্তরের কর্মচারীদের। কিন্তু সর্বত্র রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, প্রিপেড স্মার্ট মিটার বসানো বাধ্যতামূলক। এলাকা চিহ্নিত করে সমীক্ষার কাজও শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল নিয়ে মানুষের অভিযোগের সুরাহা করার আবেদন করে ডাকা হচ্ছে বিদ্যুৎ দপ্তরের আঞ্চলিক অফিসে। সেখানে ডাকার পর স্মার্ট মিটার ব্যবহারের জন্য আবেদন করছে সরকার। 

লোকসভা নির্বাচন পর্ব মেটার পরেই নবান্নে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে প্রশাসনিক পর্যালোচনা বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই বৈঠকে সরকারি দপ্তরে বিদ্যুতের অপচয় নিয়ে বেশ কিছু সময় ব্যয় করেন মমতা ব্যানার্জি। আসলে সরকারি দপ্তরগুলি, স্কুল সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপুল বিদ্যুৎ বিল মেটাতে গিয়ে কার্যত জেরবার রাজ্য প্রশাসন। একইসঙ্গে বিপুল টাকা বকেয়া পড়ে থাকছে। বিদ্যুৎ দপ্তর সূত্রের খবর, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কাছে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির বকেয়া বিলের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। 

বিলের টাকা বকেয়া রাখার সঙ্গে আসলে সরকারি দপ্তরে স্মার্ট মিটার বসানোর কাজ জড়িত। ইতিমধ্যে রাজ্যের সমস্ত সরকারি দপ্তর, সরকার অধিগৃহীত সংস্থার পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক সংস্থায় স্মার্ট মিটার চালু করার জন্য নির্দেশিকা জারি করে রেখেছে বিদ্যুৎ দপ্তর। সেই কাজ দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে হলে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে শূন্যে নামিয়ে আনা দরকার। কারণ, স্মার্ট মিটার একবার বসিয়ে দেওয়ার পর বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রাখার আর কোনও সুযোগ থাকবে না। তাই এখন থেকে বিদ্যুৎ অপচয়ের ধুয়ো তুলে রাজ্যের সরকারি দপ্তরে স্মার্ট মিটার বসানোর প্রক্রিয়া শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার।

মুখ্যমন্ত্রী যেমন মুখে একবারের জন্য স্মার্ট মিটার বসানো নিয়ে কোনও শব্দ খরচ করেননি, তেমনই সাধারণ গ্রাহকদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে প্রিপেড মিটার বসানোর কুফল কী তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করা হচ্ছে না। তাৎপর্যপূর্ণভাবে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সভার পরই রাজ্যজুড়ে গ্রাহকদের কাছে স্মার্ট মিটার নিয়ে চিঠি পাঠানো শুরু করেছে রাজ্য সরকার।

গ্রাহকদের কাছে পাঠানো চিঠিতে কী বলা হচ্ছে?

বিনামূল্যে স্মার্ট মিটার বসানোর আবেদন জানিয়ে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘ ভারত সরকারের বিদ্যুৎ মন্ত্রকের গেজেট বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ধাপে ধাপে সকল গ্রাহককে প্রিপেড মোডে স্মার্ট মিটারের সাহায্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদন নিয়ে রাজ্যের সমস্ত শহর ও গ্রামীণ এলাকায় পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি একটি স্মার্ট মিটার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের ভিতরে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ মিটারকে স্মার্ট-প্রিপেড মিটারে প্রতিস্থাপন করা হবে।’’ কোন বেসরকারি সংস্থা এই প্রকল্পের বরাত পেয়েছে সেটাও সরকারি আবেদনপত্রে উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। 

এমনকি স্ট্যাটিক মিটারের তুলনায় স্মার্ট মিটার কতটা কার্যকরী তা বোঝাতে গ্রাহকদের কাছে পাঠানো চিঠিতে সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি কী সুবিধা হবে তার উল্লেখ করেছে। মোবাইল অ্যাপের সাহায্য নিয়ে নিজের বিদ্যুৎ খরচ দেখা, প্রিপেড ব্যালান্স দেখা সহ আগামীদিনে মিটার রিডিং করা নিয়ে যেসব ত্রুটি ছিল তার থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কীভাবে স্মার্ট মিটারের জন্য আবেদন করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে অবিলম্বে স্মার্ট মিটার যাতে গ্রহকরা নিতে শুরু করেন তারজন্য চিঠিতে জানানো হয়েছে।

এখনও পর্যন্ত রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানি এলাকার মধ্যে নিউটাউনের গ্রাহকদের স্মার্ট মিটারের পাইলট প্রকল্প চালু হয়েছে। সেখানে অবশ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির সঙ্গে মিটার রিডিং করতে যান কর্মচারীরাই। এখনও পর্যন্ত চালু বিদ্যুৎ মাশুলের ভিত্তিতেই বিদ্যুতের প্রিপেড মিটার চালু আছে। কিন্তু আগামীদিনে এটা যে থাকবে না, তা নিশ্চিত। 

স্মার্ট মিটারের মাধ্যমে মোবাইলের মতো বিদ্যুতের প্রিপেড পরিষেবা চালু করার প্রকল্পের নাম আরডিএসএস(রিভ্যাম্পড ডিস্ট্রিবিউশন সেক্টর স্কিম)। ২০২১সালে ‘স্মার্ট মিটারিং’এর নাম দিয়ে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক আরডিএসএস নীতি ঘোষণা করেছিল। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে আনা এই প্রকল্পকে দু’হাত তুলে ইতিমধ্যেই সমর্থন জানিয়ে রেখেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। এখন প্রিপেড স্মার্ট মিটার বসিয়ে আগামীদিনে বিদ্যুৎ মাশুলের দাম ঠিক হবে টিওডি’র ভিত্তিতে। অর্থাৎ যে সময় গ্রাহক বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, সেই সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ঠিক হবে বিদ্যুতের দাম! শেয়ার বাজারের মতো ওঠানামা করবে ইউনিট পিছু বিদ্যুতের দাম। সাধারণত সন্ধ্যার সময় বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পৌঁছায়। আগামীদিনে ওই সময় সর্বোচ্চ বিদ্যুতের দাম দিয়ে কিনতে হবে। গ্রাহকদের কাছে পাঠানো সহযোগিতার চিঠিতে কোথাও বিদ্যুৎ আইনের ভয়াবহ পরিণতির একটি কথাও খরচ করা হয়নি।

আসলে স্মার্ট মিটার চালু করার বিরুদ্ধে গোটা রাজ্যেই পথে নেমেছে বিদ্যুৎ গ্রাহকরা। সিআইটিইউ সহ বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন স্মার্ট মিটারের বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ দপ্তরের আঞ্চলিক অফিসে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তেমনই গ্রাহকদের মধ্যে প্রিপেড মিটারের কুফল নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে। বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংগঠন অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে বিদ্যুৎ দপ্তরের গ্রুপ অফিসগুলিতে স্মার্ট মিটারের বিরুদ্ধে শয়ে, শয়ে চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সরকারকে পালটা লেখা সেই চিঠিতে গ্রাহকদের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, এই স্মার্ট মিটার এখন পোস্ট পেইড থাকবে, কিন্তু তারপর প্রিপেড হবে। টিওডি (টাইম অব ডে) সিস্টেমে বিল ও ডায়ানমিক ফেয়ার প্রাইসিং (চাহিদা অনুযায়ী মাশুল বাড়ানো) ব্যবস্থা করা হবে। এমনকি কৃত্তিম মেধার নিয়ন্ত্রণে রাখা থাকবে এই স্মার্ট মিটার। ফলে আগামীদিনে লুটের ক্ষেত্র হবে এই ব্যবস্থা। প্রায় আট দফা সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংগঠনের তরফে বিদ্যুৎ দপ্তরকে পালটা চিঠি দিয়ে স্মার্ট মিটার বসানোর বিরোধিতা করা হয়েছে। অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বিশ্বাস জানান, ‘‘গ্রাহকদের তরফ থেকে বিদ্যুৎ দপ্তরের কাছে চিঠি পাঠিয়ে জানানো হচ্ছে, আমরা স্মার্ট মিটার ব্যবহার করব না। সেই চিঠির বক্তব্য খন্ডন করতে না পেরে বিদ্যুৎ কোম্পানি এখন ঠেকায় পড়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিতে শুরু করেছে।’’

Comments :0

Login to leave a comment