Story — SOURAV DUTTA / MUKTADHARA - 16 October

গল্প — সাঁকো / মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

Story  SOURAV DUTTA  MUKTADHARA - 16 October

গল্প / মুক্তধারা

সাঁকো

সৌ র ভ  দ ত্ত

১৬ ই অক্টোবরের এক শিশির সিক্ত সকালে রামানুজ ফিরে যাচ্ছে তার ইতিহাসের ক্লাসে। 
এ এক অন্য রাখীবন্ধনের গল্প–ক্লাস টেন এ পড়ার সময় আনিসুর বাবু বলেছিলেন–আমাদের আসল রাখীবন্ধন উৎসব কিন্তু, ১৬ই অক্টোবর।ওইদিন বাংলায় বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়।আর অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জেগে ওঠে আসমুদ্র হিমাচল ভারতবাসী।রামানুজ ইতিহাসের সূত্রধর হয়ে ওঠে।

ছোট্ট সাঁকোর উপর দিয়ে হেঁটে আসছে স্কুলপড়ুয়া  ছেলেমেয়ের দল।পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে কানা দামোদর।ওদের প্রত্যেকের হাতেই গোছা গোছা হলদে সুতোর রকমারি রাখী।
–কোনটায় ময়ূর পুচ্ছের সন্নিবেশ আবার কোনটায় স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা।আজ একশো ত্রিশ কোটি বাঙালির রাখীবন্ধন উৎসব –পাড়ার মনোহারি দোকানগুলোতে সকাল থেকে বেশ ভিড় জমেছে।সাঁকোটা থেকে নামছে গিয়ে ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ে বেমালুম রাস্তায় পড়ে গেল।গ্রামে "জল স্বপ্ন প্রকল্প"এসেছে।রাস্তার বারোটা বেজেছে।ঠিকেদার সংস্থার লোকেদের বললেও কানে নেয় না।দাঁতাল জেসিবি দিয়ে মাঝে-মাঝেই অপরিকল্পিত, ছন্নছাড়াভাবে রাস্তা খোঁড়া হয়েছে।চারদিকে খোঁদল গর্ত।এইভাবে কত সরকারি টাকা তছরূপ হয়ে যাচ্ছে।অনেক বাড়িতে কলের মুখ দিয়ে এখনো ঠিকঠাক জল পড়ে না।তার উপর সামনে পঞ্চায়েত ভোট গেল।সব মিলিয়ে বর্ষায় জল জমলে গ্রামে এক চরম অব্যবস্থা। প্রচণ্ড পিছল হয় পাড়ার রাস্তায়।বিস্তর টো-টো গাড়ির দৌরাত্ম্যে পথচারীরা রোজ দুর্ভোগে পড়ে।এই তো সেদিন গর্তে পড়ে বাজার ফেরতা নিতাইবাবুর পাছা ভাঙল।পড়ে যাওয়ার ঘটনা নিত্ত নৈমিত্তিক।

তার মধ্যে আহাম্মুকেরা ধুয়ো তুলছে–"হর ঘর জল।সবকা সাথ সবকা বিকাশ।"
–খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে… 
সেদিন হাবু'দা বলছিল– হ্যাঁ যা বিকাশ হচ্ছে মাইরি!আর বলে আর কাজ নেই।দেশ বিক্রি হবার জোগাড়।আর একদিকে গালভরা ভাষণ।

শরতের সকালে চরাচরে শিউলির ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে।যদিওআকাশের মুখ সকাল থেকেই গোমড়া।মেয়েটাকে পড়ে যেতে দেখেই মোহনের চায়ের দোকান থেকে ছুটে এল এক ফেরিওয়ালা বৃদ্ধ।এসে মেয়েটাকে কাদা থেকে টেনে তুলল।মেয়েটার পা অনেকটা ছড়ে গেছে, হাঁটু দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।সামনেই "কুমুদিনী জনঔষধি কেন্দ্র"।ওখানে নিয়ে যেতে ওষুধের দোকানের কাকু পায়ে কি একটা! মলম লাগিয়ে দিল।দেদার জেনেরিক ওষুধ স্বল্পমূল্যে দেদার বিক্রি হচ্ছে পাড়ার দোকানে।লম্বা লাইন পড়েছে।আসলে গ্রাম-বাংলায় মানুষ যেখানে ঠকে সেখানেই বেশি যায়।বন্ধুদের জন্য আনা তার রাখিগুলো সব পড়ে  রাস্তায় পড়ে একেবারে কাদামাখামাখি।স্কুলের ইউনিফর্মেও কাদা লেগে গেছে।মেয়েটা যখন ওষুধের দোকান থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে যখন ওর চোখ কান্নায় মরীচিকার মতো চিকচিক করছে।আজ মায়ের থেকে অনেক বায়না করে টাকা নিয়ে এসেছিল।অরূপকাকুর দোকান থেকে কত সাধ করে রাখিগুলো কিনেছিল ঐন্দ্রিলা।ওর বাবা ধূলাগোড়ে সামান্য  একটা চিপস ফ্যাক্টারিতে কাজ করে।কোভিডের পর থেকে তাদের অবস্থা খুব শোচনীয়।মাঝে সবজির ব্যবসা করেছিল গ্রামে। কিন্তু সেরকম ভালো চলেনি।তার মা বাড়িতে মাটির পুতুল তৈরি করে প্রতি বৃহস্পতি ও রবিবার  মুন্সিরহাটে বিক্রি করে সংসার চালায়।তাও বর্তমানে বৃহৎপুঁজির দখলদারিতে  একদা লোকসংস্কৃতির ধারক মৃৎশিল্পটি এখন গ্রাম বাংলায় অবলুপ্ত হতে বসেছে।কয়েকটা জায়গায় টিমটিম করে টিকে আছে।

রাখিবন্ধনের জন্য আগেভাগে রাখি কিনে রেখেছিল ঐন্দ্রিলা। স্কুলের স্যার,ম্যাডাম ও প্রিয় বন্ধুদের পরাবে বলে।
–১৯০৫ লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এভাবেই প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল বাংলার মানুষ।হাজার হাজার মানুষ দৃপ্ত পদক্ষেপে  পা মিলিয়ে ছিল মিছিলে।সেদিন পুষ্পবৃষ্টি হয়েছিল বাংলার আকাশজুড়ে।ঘরে ঘরে পালিত হয়েছিল অরন্ধন।ব্রিটিশের বাংলাভাগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ।

উদাত্ত সুরে রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধেছিলেন–
"বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল
পুণ্য হউক পুণ্য হউক
পুণ্য হউক হে ভগবান।"

একশ বছর পেরিয়ে এসেও চিত্রটা পাল্টায়নি।বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের উপর নির্যাতন সমানে চলছে।ব্রিটিশ ভারত থেকে চলে গেছে কিন্তু দেশ ও ভাষার উপর আক্রমণ বিন্দুমাত্র কমেনি।সমানে বাংলা ভাগের চক্রান্ত  চলছে।স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব।বিদ্যাসাগরের মতো প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদের মূর্তি ভাঙা হচ্ছে।

–একদিন এই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই কিনা, একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছিল –বাংলাদেশ।

অতুলপ্রসাদ সেন লিখেছিলেন–"মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!"

যাই হোক–সময় অনেক হল খোঁড়াতে খোঁড়াতে স্কুলে ঢোকে ঐন্দ্রিলা।তার চোখেমুখে কান্নার রেশ।ইলেভেন-টুয়েলভের দিদিরা সবাই কি  সুন্দর লাল-নীল-সবুজ-হলুদ শাড়ি পড়ে এসেছে।ফার্স্ট পিরিয়ডের পর গার্লস স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে।অনুষ্ঠানে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে– যার ক্যাপশন–"হিন্দু না; ওরা মুসলিম?"

ক্লাস শুরু হতেই সোহিনী ম্যাডামের হাত ভর্তি করে রাখি পরিয়েছে ক্লাস সেভেনের মেয়েরা।শুধুমাত্র ঐন্দ্রিলা ছাড়া।রাখিগুলো ওভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার মনে কিছুটা বিষণ্ণতার ছায়া।ছাত্রীদের জোরাজুড়িতে সোহিনী ম্যাডাম বলতে থাকেন– ১৬ই অক্টোবর দিনটির গুরুত্ব সম্বন্ধে।এছাড়া রাখীবন্ধন উৎসব সম্পর্কিত বিভিন্ন মাহাত্ম্যের কথা।পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।সোহিনী ম্যামের কথাগুলো শুনতে শুনতে ঐন্দ্রিলা যেন কোন ভাবরাজ্যে হারিয়ে যায়।রামনুজ আর ঐন্দ্রিলা ধরে আছে দুটো সময়কে –যেন দূরবীণের ভিতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের সময়সারণি…

সোহিনী ম্যাম বলে চলেন–জানো তো; মহাভারতের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কৃষ্ণের হাতে আঘাত লেগে রক্তপাত হলে নিজ শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের কবজিতে বেঁধে দেন পাঞালি।সেই থেকে পাঞ্চালিকে বোন হিসাবে স্বীকার করেন তিনি।এছাড়া চিতোরের রাণি কর্ণবতী নিজ রাজ্য রক্ষার্থে মোঘল সম্রাট হুমায়ূনকে একটি সুন্দর রাখী প্রেরণ করেছিলেন।এরকম বহু ঘটনা আছে রাখীবন্ধনকে কেন্দ্র করে।

–এর মাঝে কখন ঘন্টা পড়ে গেছে। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তার সব বন্ধুরা সারিবদ্ধভাবে হাজির হয়েছে নিচের সেমিনার হলে।ক্লাসরুমে ব্যাগে মাথা রেখে; জানালার দিকে  চেয়ে নিমগাছটার ফাঁক দিয়ে–ঐন্দ্রিলা দেখছে –ভাঙাচোরা হস্টেল বাড়ির মাথায় মেঘমন্দ্রিত ছন্দে বৃষ্টি আসছে…
তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় দাদুর মুখে শোনা রবিঠাকুরের ছড়াটা–
"বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এল বান।"

মাঠে মাঠে সবুজ ধানখেতে নলসংক্রান্তিতে নলগাছ পুঁততে চলছে গ্রাম্য চাষীর দল।

স্কুলের মাইকে বাজছে–
"পরানে বেঁধেছো যে রাখি তারে খুলো না।"

ঐন্দ্রিলা দেখতে পাচ্ছে সম্প্রীতির আকাশ ছেয়ে মুষলধারে বৃষ্টি আসছে…বৃষ্টি আসছে…

বহুদূরে; পবিত্রতার সুতোর মতো ছোট্ট সাঁকোটা দাঁড়িয়ে আছে।।

Comments :0

Login to leave a comment