Sundarban

রক্ত নেই সারিকাদের? সে হুঁশ নেই

ফিচার পাতা

প্রতীম দে

বাঁধের সমস্যা আছে। তৃণমূলের প্রধান, উপপ্রধানরা স্বীকার করছেন। পানীয় জলের সমস্যা? তাও মানছেন। জলস্তর নেমে গেছে। টিউওয়েল খারাপ হয়ে গেছে বেশিরভাগ। মানছেন তৃণমূলের নেতারাও। 
রক্তাল্পতা? বিশেষত মহিলাদের? ‘‘না, এমন কিছু তো নেই। শুনিনি তো।’’ জবাব একবাক্যে। সব তৃণমূলীর। 
সারিকাও জানেন না। তাঁর হাত কেটে গেলে রক্ত পড়ে। থামতেই চায় না। শরীরে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু হিমোগ্লোবিন মাত্র ৬.৫। বয়স ১৬। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী যা হওয়া উচিত ১১-১৪। একটি হোমে থাকে সারিকা। গোসাবার একটি হোমে। 
সারিকা যখন জানতে পারে এই রোগের কথা তখন কিছুটা অবাক হয়েই বলে,‘‘কোনোদিন তো শুনিনি। আমার রক্ত কম। কই হাত কেটে গেলে তো রক্ত পড়ে।’’ 
জীবনে অনেক কঠিন লড়াই লড়েছে মেয়েটি। তখন লড়াই ছিল পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে। আজ লড়াই নিজের সঙ্গে। 
মাত্র ১৩ বছর বয়সে পরিবারের পক্ষ থেকে ওর বিয়ে দেওয়া হয়। তারপর শ্বশুর বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দিলে টাকার জন্য পরিবারের লোকেরা তাঁকে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু লেখা পড়া করার স্বপ্ন ছোট বেলা থেকে দেখেছে সারিকা। পুলিশের সাহায্য নিয়ে কোনোমতে নিজেকে সে বাঁচায়। প্রথমে চাইল্ড লাইন ও পরে নরেন্দ্রপুরের সংলাপ হোম হয় তার ঠিকানা। এরপর মেয়েটি পড়াশোনা করতে চাওয়ায় চলতি বছর জানুয়ারিতে তাকে শিবগঞ্জের একটি হোমে পাঠানো হয়, আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত এখানে থেকে সে পড়াশোনা করবে।
শুধু সারিকা নয় বাসন্তী, গোসাবা ব্লকের ৯৭ শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতায় ভুগছেন। ঠিক। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন ‘‘আমার মায়েরা লক্ষীর ভাণ্ডার পায়।’’ সেই রাজ্যের দুটি ব্লকে মহিলাদের স্বাস্থ্যের এই বেহাল দশা। 
কোনও সরকারি পরিসংখ্যানে এই তথ্য উঠে আসেনি। এই তথ্য উঠে এসেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজের মাধ্যমে। সংস্থার নাম কেয়ার সুন্দরবন। বিভিন্ন সময় এই প্রান্তিক এলাকার মানুষের জন্য এই সংস্থা কাজ করে থাকে। একটি স্বাস্থ্য শিবির করতে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর তথ্য তাদের হাতে উঠে এসেছে। 
বাসন্তী, গোসাবা ব্লকে কি কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই? কোনও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র নেই? যেখানে এই সব রোগের চিকিৎসা বা প্রসূতি মহিলাদের আয়রন ট্যাবলেট দেওয়া হবে। 
আছে। কিন্তু এখানে কোনও কাজ হয় না। স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার নেই। কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েতের দাবি এই ব্লকে মহিলাদের মধ্যে কোনও রক্তালপোতার সমস্যা নেই। গোসাবা ব্লকের যেই পঞ্চায়েত এলাকায় এই সমস্যা প্রবল সেই রাঙাবেলিয়া পঞ্চায়েতের উপপ্রধান দেব প্রসাদ সরকারের দাবি এই সমস্যা তার জানা নেই।
তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘কি, রক্তাল্পতা? না না এই ধরনের কোনও সমস্যা আমাদের এখানে নেই। আশা কর্মীরা নিয়মিত সব কিছু দেখে তাদের কাছেও এই ধরনের কোনও তথ্য নেই।’’ মাসে কত আয়রন ট্যাবলেটের পাতা আশা কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ঠিক মনে নেই।’’ তবে দেবপ্রসাদ সরকার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসকের অভাবের কথা মেনে নিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার নেই। চিকিৎসার জন্য মানুষকে গোসাবা প্রাথমিক হাসপাতালে যেতে হয়। আর সেখানে না হলে কলকাতা। 
তৃণমূল পরিচালিত রাঙাবেলিয়া পঞ্চায়েত প্রধান ভারতী মণ্ডল গায়েনের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করে হলে তিনি কোন উত্তর দেননি। 
বাসন্তী, গোসাবা ব্লকের কোনও মানুষ অসুস্থ হলে তাদের একমাত্র ভরসা গোসাবা প্রাথমিক হাসপাতাল। কিন্তু সেখানেও ঠিক ভাবে চিকিৎসা হয় না এমনটা দাবি করছেন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা। 
নমিতা গায়েন। গৃহ সহায়িকার কাজ করেন। বাড়ি গোসাবায় হলেও কলকাতায় ছোট ঘর ভাড়া করে থাকেন। তিনি বলেন, ‘‘গোসাবায় কেউ অসুস্থ হলে তাকে ওই গোসাবা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। যেই স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে সেখানে তো কিছু হয় না। আর যদি বড় কিছু হয় তাহলে হাসপাতাল থেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’’ 
গোসাবা, বাসন্তী ব্লক মিলিয়ে প্রায় আট লক্ষ মানুষ থাকেন। আর আট লক্ষের জন্য একটি মাত্র হাসপাতাল। 
তাহলে কি অসুস্থ হলে সবাই হাসপাতালেই যায়। না। প্রথমে তারা ডাক্তারের কাছে যায়। ৫০ টাকার ডাক্তার। কোয়াক ডাক্তার। ওষুধ দিতে দিতে ডাক্তার হয়েছেন তারা। কিন্তু সেখানে গিয়ে ছোট কোনও অসুখ থেকে সুস্থতা পেলেও দীর্ঘ কোনও অসুখ থেকে পাওয়া কোনোভাবে সম্ভব নয়। 
কেয়ার সুন্দরবনের অন্যতম কর্মকর্তা ভাস্কর পালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘গত ৬ মে আমরা ৮০ জন মহিলার হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করি সেখানে দেখা যায় যে অর্ধেকের বেশির রক্তাল্পতায় ভুগছেন।’’
চিকিৎসকদের মতো অপুষ্টির জন্য এই ধরনের রোগ দেখা যায়। কিন্তু সঠিক সময় এর কোনও চিকিৎসা না হলে ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করবে। সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। 
তবে এই অঞ্চলে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র হোক বা হাসপাতাল কোথাও এই ধরনের পরীক্ষা করা হয় না।
হোগল, মাতলা, রায়মঙ্গল, কালিন্দি, বিদ্যাধরী, গমুর, দুর্গাদোয়ানি নদী দিয়ে ঘেরা এই অঞ্চল বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে খবরে উঠে এসেছে। আয়লা, আমফানের মতো ঝড় সামলেছে এখানকার মানুষ। সুন্দরবনের মহিলাদের নিয়ে ওয়েব সিরিজ হয়েছে। এখানকার মহিলারা আর কোনও হস্তশিল্পের কাজ করে কিনা তা অনেকেই জানেন না। আসলে সুন্দরবন বলেই বাঘে মানুষের লড়াইয়ের কথা মনে পড়ে। আর তাই নমিতা গায়েনরা বাধ্য হয়েই বলেন, ‘‘আমাদের কথা কেউ মনে রাখে না গো। যারা বাইরে এসে কাজ জুটিয়ে নিয়েছি তারা কিছুটা ভালো আছি। কিন্তু ওখানে কারুর কিছু হলে কিছু করার নেই। চিকিৎসা না পেয়ে কতজন মারা গিয়েছে তার খবর কে রাখে।’’

Comments :0

Login to leave a comment