UAPA Act

দানবীয় ইউএপিএ প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি বিজেপি-রাজ্যেই

জাতীয়

 কুখ্যাত বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে (ইউএপিএ) মামলা ও ধরপাকড়ের সংখ্যা মোদী আমলে মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছে। ২০২২ সালেও ইউএপিএ’তে নথিভুক্ত মামলা আগের বছরের তুলনায় একলাফে বেড়েছে ১৭.৯ শতাংশ। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)’র সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে সরকারিভাবে এই তথ্য কবুল করা হয়েছে। কার্যত বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের জন্য ব্যবহৃত এই কুৎসিত আইনের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতেই, জানিয়েছে খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরিচালনাধীন এনসিআরবি’র সমীক্ষা।
এনসিআরবি’র বার্ষিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২১ সালে সারা দেশে  ইউএপিএ’তে নথিভুক্ত মামলার সংখ্যা ছিল ৮১৪ টি। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা একলাফে বেড়ে হয়েছে ১,০০৫! দু’বছর আগে ২০২০ সালে ইউএপিএ’তে মোট ৭৯৬ টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছিল।
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরেই সারা দেশের সবচেয়ে বেশি, ৩৭১ টি ইউএপিএ মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপি-শাসিত মণিপুর রাজ্য। বিজেপি মদতে লাগাতার জাতিসঙ্ঘর্ষে বিধ্বস্ত রাজ্যটিতে ইউএপিএ’র মামলা হয়েছে ১৬৭ টি। এরপরেই রয়েছে আরও দুই বিজেপি-শাসিত রাজ্য, আসাম ও উত্তর প্রদেশ। ২০২২ সালে এই দুই রাজ্যে ইউএপিএ মামলা হয়েছে যথাক্রমে ১৩৩ এবং ১০১ টি।
প্রসঙ্গত, ইউএপিএ মূলত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার আইন হলেও মোদী-আমলে এখন এটির যত্রতত্র অপব্যবহার করা হচ্ছে। ‘সন্ত্রাসবাদ’ মোকাবিলার নামে বাস্তবে রাজনৈতিক বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে এবং তাঁদের জেলে পাঠাতেই দানবীয় চরিত্রের ইউএপিএ আইনকে কাজে লাগানো হচ্ছে, এই অভিযোগ এখন দেশজুড়ে।
কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে ১৯৬৭ সালের মূল ইউএপিএ আইনটিকে সংশোধন করে ২০১৯ সালে আরও দানবীয় চেহারা দেওয়া হয়। নয়া আইনের সংস্থান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এখন যে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে ঘোষণা করার ক্ষমতা রয়েছে। এই আইনের রাজনৈতিক অপব্যবহারের আশঙ্কায় বিরোধীরা প্রবল আপত্তি জানালেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদের দুই কক্ষেই সংশোধনী বিলটি পাশ করিয়ে নেয় মোদী সরকার। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রপতির সম্মতি মেলায় চালু হয়ে যায় এই ভয়াবহ আইন।
কেন্দ্রের বিজেপি-আরএসএস আমলে বিতর্কিত ইউএপিএ’র ধারায় ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী সহ অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা এবং সাজানো মামলা চাপানো হয়েছে। দিনের পর দিন কার্যত বিনা বিচারে আটক রেখে তাঁদের যথেচ্ছ হয়রানি করা হচ্ছে। অতি সম্প্রতি গত ৩ অক্টোবর একই কায়দায় সাজানো অভিযোগে ইউএপিএ’তে জেলে পোরা হয়েছে স্বাধীন সংবাদ পোর্টাল ‘নিউজক্লিক’র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে। এই মুহূর্তে তিনি ছাড়াও কমপক্ষে ১৬ জন সাংবাদিকের ঘাড়ে এখন ঝুলছে ইউএপিএ। এর আগে সিএএ-এনআরসি বিরোধী ছাত্রনেতা উমর খালিদ, কবি ভারভারা রাও, দলিত অধিকারের আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বদে, সুধীর ধাওয়ালে, সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ, ভারনন গঞ্জালভেস, অরুণ ফেরেইরা, মহেশ রাউথ, রোনা উইলসন, অধ্যাপিকা সোমা সেন, অধ্যাপক হানি বাবু, আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিঙ, সাংবাদিক গৌতম নাভলাখার মতো প্রতিবাদীদের জেলবন্দি করা হয়েছে। সরকারের হিংস্রতম অত্যাচারের পরিণতিতে বিচারবিভাগীয় হেপাজতেই মারা যান এদেশের মানবাধিকার ও আদিবাসী অধিকার কর্মী অশীতিপর ফাদার স্ট্যান স্বামী।
শুধু ইউএপিএ’ই নয়, মোদী-আমলে একই কায়দায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলাও বেড়ে চলেছে বলে জানাচ্ছে এনসিআরবি’র রিপোর্ট। এক্ষেত্রেও অভিযোগ রয়েছে বিরোধীদের কণ্ঠরোধের। এনসিআরবি’র তথ্য, ২০২২ সালে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের মোট ৫,৬১০ টি মামলা হয়েছে। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৫,১৬৪। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ২০২২ সালে এই ধরনের মামলার প্রায় অর্ধেকই হয়েছে উত্তর প্রদেশে, ২২০৭ টি। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তামিলনাড়ু , ৬১৮ টি মামলা।
এদিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই বুধবার রাজ্যসভায় দাবি করেছেন, গত ছ’বছরে জম্মু-কাশ্মীরে উগ্রপন্থী তৎপরতা তলানিতে নেমে এসেছে। এক প্রশ্নের লিখিত জবাবে পরিসংখ্যান দিয়ে মন্ত্রী বলেন, চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীরে উগ্রপন্থী তৎপরতার মাত্র ৪১ টি ঘটনা ঘটেছে। তুলনায় ২০২২ সালে এই সময়ের মধ্যে সেখানে এমন ঘটনা হয়েছিল ১২৫ টি। এছাড়া ২০২১ সালে ১২৯টি, ২০২০ সালে ১২৬ টি, ২০১৯ সালে ১৫৩ টি এবং ২০১৮ সালে ২২৮ টি উগ্রপন্থী হামলার ঘটনা ঘটে। একইসঙ্গে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্ঘর্ষ, অসামরিক নাগরিক হত্যা, কর্মরত অবস্থায় নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানের নিহত হওয়ার ঘটনার তথ্য হাজির করে মন্ত্রী মন্তব্য করেন, উগ্রপন্থার প্রতি সরকারের কঠোরতম নীতির কারণেই পরিস্থিতি উন্নত হয়েছে।
তবে সংসদে মন্ত্রীর এই দাবির পরেই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কেন দানবীয় ইউএপিএ ধারায় মামলা কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীরেই সবচেয়ে বেশি নথিভুক্ত হয়েছে? প্রশ্ন উঠেছে, পরিস্থিতির এতটা উন্নতি হলেও জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচন কেন আটকে রেখেছে কেন্দ্র? কেন বিধানসভা ভোটের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরবাসীকে ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না ? এসবের কোনও জবাব অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এদিনও পাওয়া যায়নি।
 

Comments :0

Login to leave a comment