ফ্রান্সের অকাল সংসদীয় নির্বাচনে ১৮০ আসনে জিতেছেন কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, মধ্য বামপন্থী ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের মঞ্চ নিউ পপুলার ফ্রন্ট প্রার্থীরা। অধিকাংশ জনমত সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বৃহত্তম জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন বামমুখী মঞ্চ।
প্রথম দফার সংসদীয় নির্বাচনের ফল অনুযায়ী, জয়ের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল ফ্রান্সের উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তি ন্যাশনাল ফ্রন্ট। বামপন্থীদের উত্থান উগ্র দক্ষিণপন্থীদের ঠেলে দিয়েছে তৃতীয় স্থানে, ১৪২টি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের। তবে একা সরকার গড়ার মতো গরিষ্ঠতা বা অর্ধেকের বেশি আসন পায়নি কোনও জোটই।
মাঝখান থেকে বাতিলের খাতায় চলে যাওয়া, বর্তমান ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইম্যানুয়েল ম্যাঁক্রর মধ্যপন্থী জোট পেয়েছে ১৫৯ আসন। রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রথমবারের জন্য উগ্র দক্ষিণপন্থী সরকার তৈরির ভ্রুকুটি দেখা দিয়েছিল ফ্রান্সে। বামপন্থীদের তৎপরতায় রোখা গিয়েছে সেই বিপদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের পুতুল ভিচি সরকার ফ্রান্সে নাৎসী সন্ত্রাসের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছিল। ৭৯ বছর পেরোলেও ফরাসিদের স্মৃতিতে সেই দাগ এখনও তীব্র।
নিউ পপুলার ফ্রন্টের অন্যতম প্রধান নেতা ফ্রান্স আনবোড দলের নেতা জ্যাঁ লুক মেলেশঁ। তাঁর দল সবচেয়ে বেশি আসনও পেয়েছে। মেলেশঁ’র জয়ের পরে তাঁকে নিয়ে অবিরাম কুৎসা করা শুরু করেছে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম। বাজার অর্থনীতি এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের বরাবরের সমর্থক সংবাদমাধ্যম তাঁকেই এখন ‘বামপন্থী জোটের সমস্যা’ বলে প্রচারে নেমে পড়েছে। লক্ষ্য, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যেন কোনোমতেই মেলেশঁকে ডাকা না হয়।
মধ্যপন্থী ম্যাঁক্রর দলের একাধিক নেতা বলতে শুরু করেছে, উগ্র দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে মেলেশঁ’র কোনও তফাত নেই, কারণ তিনিও কট্টরপন্থী। তাই তাঁকে সামনে রাখলে নিউ পপুলার ফ্রন্টের সঙ্গে কোনও জোট গড়া হবে না। প্রয়োজনে রাজনৈতিক অস্থিরতা জিইয়ে থাকবে দেশে।
মিডিয়ার পাশাপাশি সক্রিয় হয়েছে বিনিয়োগ সংস্থা বা আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির প্রধান কর্তারা। ফ্রান্সের শেয়ার বাজারের গতি শ্লথ করানো হয়েছে। ঘুরিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা চলছে, মেলেশঁ দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে বাজারের আস্থা হারাবে ফরাসি সরকার। ফরাসি জনাতর বিপুল অংশের আস্থাকে দমিয়ে দিতে নেমেছে হাতে গোনা কয়েকজন নিয়ন্ত্রিত শেয়ার বাজার।
একদল রাজনৈতিক বিশ্লেষককে নামানো হয়েছে এই লক্ষ্যেই। তাঁরা বলছেন, উগ্র দক্ষিণপন্থীরাও একই ভাষায় কথা বলছিলেন নির্বাচনের প্রচার চালাকালীন। তাঁদের দাবি ছিল, ন্যশনাল ফ্রন্ট ভোটে না জিতলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। কার্যক্ষেত্রে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের ভাষ্যকে সত্যি প্রমাণের গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে মধ্যপন্থীরা।
কিন্তু মেলেশঁ’র প্রতি এই বিদ্বেষের কারণ কী?
ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, দেশের ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের জন্য সরাসরি নয়া উদারবাদী অর্থনীতির বেলাগাম পথচলাকে দায়ী করেছেন মেলেশঁ। একের পর নির্বাচনী সভায় ধারাবাহিক ভাবে তিনি বলেছেন, ‘‘এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বরদাস্ত করা অন্যায়। মানুষের প্রাপ্য থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমরা এই ব্যবস্থার বদল আনব।’’ বলেছেন, ‘‘কয়েকজনের হাতে থাকা বাজার বিপুল দেশবাসীর যন্ত্রণার বিনিময়ে মুনাফার পাহাড় গড়ছে। এই নির্মম অর্থনীতি কারও মঙ্গল করতে পারে না।’’ বলেছেন, অতি ধনীদের ওপর কর বষসাতে হবে। জনকল্যাণের ব্যয় করতে হবে অর্থ। বাড়াতে হবে ফ্রান্সের শ্রমিকদের মজুরির হার। কৃষি বহুজাতিকের থাবা থেকে বাঁচাতে হবে রাস্তায় নামা কৃষকদের। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যয় শ্রমজীবী বিরোধী নীতির প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। প্যালেস্তাইনের জনতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকেই বলা হচ্ছে ইহুদি-বিদ্বেষী।
নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট হয়েছে, ফ্রান্সের সিংহভাগ মানুষ তাঁর আবেদনে আস্থা রেখেছেন।
ফ্রান্স আনবোড পুনরায় জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। লাগাম টানার প্রতিশ্রুতি রয়েছে নব্য উদারবাদী নীতিতেও। স্বাভাবিক ভাবেই এই অবস্থানের ফলে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের পাশাপাশি বাজারমুখী মধ্যপন্থীদের রোষের মুখে পড়েছেন মেলেশঁ।
ফ্রান্সের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, ফ্রান্সে উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলিকে অক্সিজেন যুগিয়েছে দেশে বেড়ে চলা অসাম্য। কর্পোরেট ও বহুজাতিকদের মুনাফায় আঁচ লাগতে না দেওয়ার ফলে শ্রমজীবীদের আয় তলানিতে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দামে কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থার ক্ষোভ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বদলের দিকে চালিত না করে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে উগ্র দক্ষিণপন্থীরা। ক্লাসিক্যাল ছক মেনে সংখ্যা গরিষ্ঠ ফরাসির সঙ্কটের কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এশিয়া কিংবা আফ্রিকা থেকে আসা শ্রমজীবী আরেক অংশকে।
বামপন্থীদের ঘুরে দাঁড়ানোর ফলে নব্য উদারবাদের পাশাপাশি ধাক্কা খেয়েছে উগ্র দক্ষিণমুখী সেই প্রচারও। তাই চক্ষুশূল হয়েছেন মেলেশঁ।
Jean-Luc Mélenchon
চিনিয়েছেন বাজার অর্থনীতির নির্মমতাকে, ফ্রান্সে তাই আক্রমণ জয়ী মেলেশঁকেই
×
Comments :0