মার্কসবাদ পণ্ডিতদের চর্চার জন্য নিছক পুঁথিগত তত্ত্ব নয়। মার্কসবাদ একটি সৃজনশীল প্রায়োগিক বিজ্ঞান। মার্কসবাদের মর্মবস্তুকে আয়ত্ত করে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন সর্বাহারা বিপ্লবের মহান নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। মার্কস-এঙ্গেলস’র চিন্তারাশিকে সমসাময়িক পরিবর্তিত সামাজিক বাস্তবতার উপযোগী অনুপান যুক্ত করে সমৃদ্ধ করেছেন। অতঃপর তাকে প্রয়োগ করেছেন শিল্পে অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ একটি দেশে। মার্কস-র কালে মোটামুটি এমনটাই প্রতিপাদ্য ছিল যে কেবলমাত্র শিল্পোন্নত দেশেই মার্কসবাদের প্রয়োগ হবে। কিন্তু লেনিন মার্কসবাদের সঙ্গে আনুষঙ্গিক উপাদান যুক্ত করে সময়োপযোগী ও বাস্তবোপযোগী করে তুলেছেন পরিবর্তিত ও ভিন্ন বাস্তবতায় প্রয়োগের জন্য। তাই মার্কস-উত্তর মার্কসবাদের উত্তরণের তিনিই প্রথম সফল কারিগর। মার্কসবাদকে হাতিয়ার করে বিশ্বজুড়ে সর্বহারা বিপ্লবের রুদ্ধদ্বার খুলে দিয়েছিলেন তিনি। সেই পথ ধরেই পরবর্তীকালে চীনে বিপ্লব হয়েছে। সমাজতন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছে গণতান্ত্রিক কোরিয়া, কিউবা এবং ভিয়েতনাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লেনিনের তৈরি সোভিয়েত ইউনিয়ন স্তালিনের নেতৃত্বে বিশ্বত্রাস হিটলারকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল। সেই মহাবিজয়ের পর সমাজতন্ত্রের প্রভাব আরও অনেক দূর প্রসারিত হয়ে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনসমষ্টিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় আনতে সক্ষম হয়। আজ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি বুর্জোয়াদের দখলে চলে গেলেও এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটলেও সামাজিক শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্র উজ্জ্বল ও প্রাসঙ্গিক।
কোনও তত্ত্ব মতাদর্শগত শক্তিরূপে যতক্ষণ না পর্যন্ত মানুষের চেতনায় উৎসারিত হয় ততক্ষণ সেই তত্ত্ব কার্যকারিতাহীন। তত্ত্বকে প্রয়োগ করাই আসল কাজ। প্রয়োগের ক্ষেত্রে তত্ত্ব লক্ষ্যভ্রষ্ট ও বিপথগামী হতে পারে। মতাদর্শগত মৌলিকত্ত্বে অবিচল থেকে সমস্তরকমের ভ্রান্তি ও বিচ্যুতিকে নির্মমভাবে ছেঁটে ফেলে চলতে পারলেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। লেনিন প্রতি পদক্ষেপে সতর্ক থেকে দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদ ও বামপন্থী সঙ্কীর্ণতাবাদকে পরাস্ত করে বিপ্লবকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেছেন। মার্কসবাদকে পরিবর্তনশীল সমাজ বাস্তবতায় প্রয়োগের উপযোগী করার জন্যই লেনিন চির দিশারি হয়ে থাকবেন।
একটা পার্টি যারা বিপ্লব করতে চায় তারা মার্কসবাদকে কীভাবে আয়ত্ত করবে এবং প্রয়োগ করবে সেটাই হাতে-কলমে শিখিয়েছেন লেনিন। মার্কসবাদ আয়ত্ত করাই এবং তার প্রয়োগের পথরেখা তৈরি করাই যথেষ্ট নয়। মার্কসবাদ আপনা থেকে প্রয়োগ হয় না। তাকে প্রয়োগ করতে হয়। প্রয়োগ মার্কসবাদীদের বিপ্লবী পার্টি। সেই বিপ্লবী পার্টিও আপনা থেকে তৈরি হয় না, তৈরি করতে হয়। মার্কসবাদ প্রয়োগ করে সর্বহারা বিপ্লব সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিপ্লবী পার্টি তৈরি করেছিলেন লেনিন। একটি বিপ্লবী পার্টি তৈরি হয় নীতিনিষ্ঠ, আত্মত্যাগী, বিপ্লবী লক্ষ্যে অবিচল কর্মীদের নিয়ে। তাঁরা পরিচালিত হন একটি সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত ব্যবস্থার মধ্যে। লেনিন তেমন একটি পার্টি করতে পেরেছিলেন বলেই সর্বহারা বিপ্লব সফল করতে পেরেছিলেন। তেমনি শুধু শ্রমিকশ্রেণির উপর নির্ভর করে, বিশেষ করে অনুন্নত দেশে, বিপ্লব সফল করা সম্ভব নয়। তাই সেই বিপ্লবের সহযোগী শক্তি হিসাবে বৃহত্তর কৃষক সমাজকে সংগঠিত করতে হয়। শ্রমিকের সঙ্গে কৃষকের মৈত্রী না হলে বিপ্লবী শক্তি জয় ছিনিয়ে আনার স্তরে উন্নীত হয় না। এই শিক্ষাও লেনিনই দিয়ে গেছেন। তাই লেনিন শুধু মার্কস-উত্তর মার্কসবাদেরই রূপকার নয়, সমাজ বিবর্তনের ধারায় নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের নিরিখে মার্কসবাদ প্রয়োগের সূত্রধরও বটে।
Editorial on LENIN
মার্কস-উত্তর মার্কসবাদের রূপকার
×
Comments :0