যা আশঙ্কা করা হয়েছিল সেটাই হলো। বিরোধীমুক্ত সংসদে ঝড়ের গতিতে একের পর এক বিতর্কিত বিলগুলি পাশ করিয়ে নেওয়া হলো। যে বিলগুলির ছত্রে ছত্রে আছে বিতর্কের উপাদান। যেগুলি দেশের নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, বিরোধীরা যেগুলি পাশের ক্ষেত্রে প্রবল বাধা সৃষ্টি করত সেগুলিকে পাশ করানোর এই সহজ পথটা যে একেবারেই পূর্বপরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল সেই বিষয়ে আগে সন্দেহ থাকলেও এখন একেবারে নিশ্চিত। মোদী-শাহরা বুঝে গিয়েছিলেন বিরোধীরা যেভাবে জোট বেঁধে সংসদে প্রতিবাদ-বিরোধিতার স্বর চওড়া করছিলেন তাতে নাগরিক অধিকার হরণের স্বৈরাচারী কালাবিলগুলি পাশ করানো সহজসাধ্য ছিল না। বিরোধীরা বিলগুলি আটকানোর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতেন এবং তাতে সংসদে অচলাবস্থা তৈরি হতো নিশ্চিতভাবেই। তাই কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি মোদীরা। আগে থেকেই কৌশলী ছক কষে বিরোধী সাংসদদের বিতাড়নের ব্যবস্থা করে ফেলা হয়েছে। ঘটনাচক্রে সংসদে স্মোক ক্যান নিয়ে দুই যুবকের ঢুকে পড়াকে ঘিরে নিরাপত্তার প্রশ্নে বিরোধীদের প্রবল প্রতিবাদকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।
বিরোধীদের দাবি ছিল কীভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙে যুবকরা ঢুকে পড়ল তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ব্যাখ্যা করতে হবে সংসদে। কিন্তু অমিত শাহ সেই দাবি মানবেন না। বিবৃতি দেওয়া তার নৈতিক দায় হলেও এবং দেশবাসীকে নিরাপত্তার গাফিলতির কারণ জানানো কর্তব্য হলেও তিনি তা নাকচ করে দিয়েছেন। এহেন অসংসদীয় উদ্ধত আচরণে ক্ষুব্ধ বিরোধীরা তাঁদের দাবিতে অনড় থাকেন। ন্যায়সঙ্গত দাবিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিসরে বিরোধীদের এই প্রতিবাদকে অসংসদীয় আচরণ বলে দেগে দিয়ে পাইকারি হারে উভয় কক্ষ থেকে বিরোধীদের বহিষ্কার অভিযান শুরু হয়ে যায় কালক্ষেপ না করে। সব মিলিয়ে ১৪৬জন সংসদকে বহিষ্কার করা হয় গোটা শীতকালীন অধিবেশনের জন্য। বোঝাই যাচ্ছে তড়িঘড়ি একযোগে এত বিপুল সংখ্যক বিরোধী সদস্যকে তুচ্ছ অজুহাতে বহিষ্কার থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে অন্তর্নিহিত ষড়যন্ত্রের ছকটি। স্বাধীন ভারতের ৭৫ বছরের ইতিহাসে সংসদে বিরোধীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের অজস্র নজির আছে। প্রতিবাদের উত্তাল তরঙ্গে সংসদ অচল হবার ঘটনাও কম নেই। তেমনি বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কারের ঘটনাও বিস্তর ঘটেছে। কিন্তু এত তুচ্ছ কারণে এত বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কারের ঘটনা অতীতে কোনদিন হয়নি। তাছাড়া বহিষ্কার হলেও সেটা সেদিনের মতো বা দু’-একদিনের জন্য। এবার কিন্তু পরিকল্পিতভাবে পুরো অধিবেশনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল অধিবেশনের বাকি দিনগুলির জন্য সংসদের দু’টো কক্ষকেই কার্যত বিরোধী শূন্য করে ফেলা। বিরোধীরা না থাকলে ফাঁকা মাঠে পর পর গোল (বিল পাশ) দেওয়া যাবে।
বাস্তবে হয়েছেও তাই। একেবারে পরিকল্পিত ছক অনুযায়ী রাজ্যসভা ও লোকসভায় ধ্বনি ভোটে পাশ করানো হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কপিশনার নিয়োগ বিল। টেলিকম বিল, পোষ্ট অফিস বিল, ন্যায় সংহিতা, নাগরিক সুরক্ষা, সাক্ষ্য অধিনিয়ম ইত্যাদি বিল। ‘গণতন্ত্রের জননী’ দেখলেন ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে’ কোনরকম সমালোচনা-বিতর্ক ছাড়া বিল পাশ হওয়া। বিল পেশের পর বিলের উপর কোনো আলোচনা নেই। সরকার পক্ষে জো হুজুরেরা সরকারের সাফল্যের প্রশংসা আর মোদী বন্দনায় মেতে ওঠেন। মধ্য যুগের রাজসভায় যেমন সভাসদরা রাজার গুণকীর্তণে মেতে উঠতেন মোদী ঘোষিত অমৃতকালে ‘নতুন’ ভারতের নতুন সংসদও ভরে উঠেছে তেমনই মোদীময়তায়। কে বলবে গোটাটাই আগে থেকে সাজানো নয়?
Editorial Opposition Mukt Parliament
ছক বেঁধে
×
Comments :0