রানি রাসমণি অ্যাভেনিউ পেরিয়ে ডানদিকের ফুটপাথে উঠতেই নাকে এল তীব্র উৎকট গন্ধ। মানুষের প্রস্রাব, মাংস পচার গন্ধের সঙ্গে মিশে রয়েছে জঞ্জাল পচার গন্ধ। সেই ফুটপাথ ধরে কিছুটা এগোলেই, ডান হাতে সুরেন্দ্রনাথ পার্ক।
এই পার্কের আগে নাম ছিল কার্জন পার্ক। এখানেই রয়েছে বাংলা ভাষা শহীদ স্মারক। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল, সারাবছর আবর্জনায় ঢাকা থাকলেও, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের আগের দিন উদ্যান পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন কলকাতা কর্পোরেশনের উদ্যান বিভাগের কর্মীরা।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময়ে কার্জন পার্কে চলছিল জোর কদমে স্মারক এবং বাগান পরিষ্কারের কাজ। চারপাশে সদ্য কেটে ফেলা আগাছার চিহ্ন। তখনও পার্কের মাটির বেশ কিছু জায়গায় রয়েছে মানুষের মলের স্তূপ। মার্বেলের তৈরি স্মারক পরিষ্কার করছিলেন ৭-৮জনের একটি দল। সেই দলেরই একজন শ্রমিক সতর্ক করলেন, ‘‘দেখে পা ফেলুন। এখনও মাটিতে মানুষের মল জমে রয়েছে।’’
প্রত্যেকেই অস্থায়ী শ্রমিক। তাঁরা জানালেন, ‘‘সকাল থেকে কাজ শুরু হয়েছে। ‘সাহেব’রা বিকেলের মধ্যে সব সাফ করে ফেলতে বলেছে। কয়েক দফায় জঞ্জাল ব্যাটারি গাড়ি করে এসপ্ল্যানেডের পুলিশ চৌকির দিকে নিয়ে গিয়ে ফেলা হয়েছে। আরও কয়েক গাড়ি মাল যাবে।’’
সারা বছর এই পার্ক পরিষ্কার করেন আপনারা?
‘‘সারা বছর পার্ক সাফ থাকলে কি আর এত গাড়ি মাল একদিনে ফেলতে হত?’’
প্রশ্নের জবাবে ধেয়ে আসে পালটা প্রশ্ন। তার পালটা প্রশ্ন আর করা গেল না। দলটির সঙ্গে থাকা ঠিকাদার গোছের একজনকে এগিয়ে আসতে দেখে কাজে মন দিলেন বছর বাইশের শ্রমিক। তাঁর নাম জানারও অবকাশ মিলল না।
এই টুকরো কোলাজ থেকেই স্পষ্ট, সারা বছর অনাদর, অবহেলায় পড়ে থাকে ভাষা স্মৃতি সৌধ। এই পথে যাতায়াতকারী নিত্যযাত্রীদের বক্তব্য, ২৪-৪৮ ঘন্টা আগেও কার্জন পার্ক জঙ্গল হয়ে পড়েছিল। পার্কের মাঝে একটি শ্বেতপাথরের তৈরি ঝালরের মতো স্থাপত্য রয়েছে। তার আশেপাশে গাঁজার ঠেক রয়েছে। মল এবং প্রস্রাব পার্ক পেরিয়ে চলে আসে ফুটপাথে। নাকে রুমাল না গুঁজে এই ফুটপাথ ধরে পথ হাঁটা দায়।
নিত্যযাত্রীদের অভিজ্ঞতা যে খুব ভুল নয়, তার প্রমাণ কার্জন পার্ক থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। পার্কের পাশের রাস্তা দিয়ে এসপ্ল্যানেড ট্রামডিপোতে যেতে গেলেই শুকিয়ে থাকা মানুষের বিষ্ঠার তাল নজরে পড়তে বাধ্য। খাতায় কলমে কলকাতা শহর যদিও ‘ওপেন ডিফেকেশন ফ্রি’।
অনাদরে ডুবে থাকা কলকাতা কর্পোরেশনের এই পার্কে ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা শহীদ স্মারকটির উন্মোচন করেন সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়। উন্মোচন অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। মার্বেলের তৈরি স্মারকের বেদী বর্তমানে ভেঙে গিয়েছে জায়গায় জায়গায়। বেরিয়ে এসেছে ইটের কঙ্কাল।
২১ ফেব্রুয়ারির আগে পরিষ্কার করা হলেও ফের আবর্জনার স্তূপে ঢেকে যাবে না তো এই উদ্যান এবং স্মারক?
Comments :0