MAMATA BANERJEE FALSE PROMISES

শিলান্যাসেই খেল খতম হাজার প্রকল্পের

রাজ্য জেলা

CPIM west bengal panchayat election TMC BJP bengali news ২০১২ সালে নন্দীগ্রামে একটি প্রকল্পের শিলান্যাস করছেন মমতা ব্যানার্জি।

শিলা পুঁতেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা ব্যানার্জির হাতে শিলান্যাস হওয়া প্রায় হাজার প্রকল্পের ভবিষ্যৎকেই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। 

৬০৬টি এমন প্রকল্প আছে যার ন্যূনতম কাজ এখনও শুরুই করতে পারেনি রাজ্য সরকার। অথচ ২০১২ সাল থেকে এমন বহু প্রকল্প শিলান্যাস হয়েছে মমতা ব্যানার্জির হাতে। নবান্ন সূত্রের খবর, এর বাইরে আছে আরও ২৬৬টি প্রকল্প। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে শিলান্যাস হওয়ার পর অর্থ বরাদ্দ করেছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু ২ বছর থেকে টানা ১০ বছর ধরে প্রকল্পগুলি শেষ করতে উঠতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর। ফলে প্রকল্পগুলির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনের অন্দরেই।


কাজ শুরু না হওয়া ও বছরের পর বছর ধরে পড়ে থেকে শিলায় শ্যাওলা পড়ে যাওয়া প্রকল্পের সংখ্যা হাজার। শিলান্যাস হওয়া এই সব প্রকল্পকে চালু ও বাস্তবায়িত করতে হলে সরকারকে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। কোষাগারের তীব্র সঙ্কটে এখন সরকার ঠিক করছে, শিলান্যাস হওয়া প্রকল্প ধরে প্রয়োজনীয়তা বিচার করা হবে। সেক্ষেত্রে বহু প্রকল্পই বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। 

বুধবার নবান্নে আরও একবার রাজ্য প্রশাসনের পর্যালোচনা বৈঠক করতে চলেছেন মমতা ব্যানার্জি। সব দপ্তরের প্রধান সচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার আধিকারিকদের সঙ্গে জেলাশাসকরা বৈঠকে যোগ দিতে চলেছেন। বৈঠকেই ঠিক হতে পারে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পোঁতা শিলার ভবিষ্যৎ। 


রেলমন্ত্রী থাকার সময় এরাজ্যে শিলার বন্যায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কারখানা থেকে হাসপাতাল, মডেল স্টেশন থেকে রেলের উদ্যোগে নার্সিং কলেজের পর্যন্ত শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির হাতে পোঁতা কোনও কারখানাই বাস্তবের মুখ দেখেনি। মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেও শিলান্যাসের ভাঁওতা জারি যে বহাল তা এখন সরকারি তথ্যেই পরিষ্কার।

ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি উত্তরবঙ্গে তিস্তা নদীর ওপর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার জন্য শিলা পুঁতে এসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। দার্জিলিঙ জেলার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানি ছিল নোডাল দপ্তর। ১১ বছরে এই প্রকল্প রূপায়ণে একটি টাকাও বরাদ্দ হয়নি। ৯০ মেগাওয়াট জল বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ এখন বিশ বাঁও জলে। 


২০১৭ সালে বীরভূম জেলায় ভীমগড়ে রেলওয়ে ওভার ব্রিজ গড়ার জন্য শিলান্যাস করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পূর্ত দপ্তরকে কাজের দায়িত্ব দিয়ে রাজ্যের তরফে বরাদ্দ করা হয়েছিল ১৩৮ কোটি টাকা। কিন্তু সেই প্রকল্পের ন্যূনতম অগ্রগতি হয়নি। 

পূর্ত দপ্তরের পক্ষ থেকে সরকারকে জানানো হয়েছে, শুরুতে জমির সমস্যা ও বেআইনি দখলদার থাকায় কাজ করা যায়নি। সেই সমস্যা মিটিয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু ফের নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে দেবোত্তর সম্পত্তি ঘিরে। যা নিয়ে মামলা চলছে। দীর্ঘসময় পড়ে থাকার ফলে এই প্রকল্পের খরচ বাড়বে। ফলে আগামীদিনে অনিশ্চিত হতে পারে রেলওয়ে ওভারব্রিজের কাজ।  


সুন্দরবনের নদীপথকে জোড়ার জন্য ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর গদখালির সঙ্গে গোসাবা বাজারকে সংযোগ করার জন্য বিদ্যা নদীর ওপর সেতুর শিলান্যাস করে এসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ২৮৪ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। চার বছর পর কাজ নিয়ে সরকারের বক্তব্য কী? কোস্টাল রেগুলেশন জোন (সিআরজেড) ছাড়পত্র না আসায় এখনও কাজেই নামতে পারেনি সরকার। সব ছাড়পত্র আসলে প্রকল্পের খরচের ভার বহন করা এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে যে দুরূহ মানছেন পূর্ত দপ্তর। 


রাস্তা, রেলওভার ব্রিজ, সেতু, পানীয় জল, বিদ্যুতের সাব স্টেশন, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র— মানুষের প্রয়োজনের একের পর প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বাস্তবে তা আর কার্যকর হয়নি। সরকারি হিসাবে ২০১২ সাল থেকে ৬০৬টি প্রকল্পের কোনও কাজই এখনও পর্যন্ত শুরু করা যায়নি।

আবার কাজ শুরু করা ২৬৬টি প্রকল্পের মধ্যে ৫টি প্রকল্প ১০ বছর ধরে কাজ চলছে। ৭ বছর ধরে পড়ে আছে ৫টি প্রকল্প। ৭৪টি শিলান্যাস হওয়া প্রকল্প বকেয়া পড়ে আছে ৪ বছর ধরে। ২০১৩ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি মমতা ব্যানার্জি ভাঙড়ে ৩৫০ কোটি টাকা খরচ করে পিপিপি মডেলে মেডিক্যাল কলেজ গড়ার শিলা পুঁতে এসেছিলেন। 

১০ বছর পর এখন মমতা ব্যানার্জির নিজের স্বাস্থ্য দপ্তর জানাচ্ছে, প্রকল্পটি ‘হায়ার অথরিটি’র উদ্যোগে নেওয়া হয়েছিল। ১০ বছরে মেডিক্যাল কলেজ গড়ার কোনও কাজ করা যায়নি।


জলপাইগুড়ি জেলা থেকে নতুন জেলা করা হয়েছে আলিপুরদুয়ার। ২০১৬ সালে জেলা পরিষদের নতুন ভবনের জন্য শিলান্যাস করে এসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। বরাদ্দ করা হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। সাত বছর পার হলেও এখনও নতুন জেলা পরিষদ ভবন তৈরি করা যায়নি। 


মেডিক্যাল কলেজ গড়ার জন্য জলপাইগুড়িকে বেছে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ শিলান্যাসও করেছিলেন। ছয় বছর সেই মেডিক্যাল কলেজে কাজ কতদূর? স্বাস্থ্য দপ্তর জানাচ্ছে, ‘ফিজিক্যাল প্রগেস’ মাত্র ২ শতাংশ! ছয় বছর আগে হাওড়ার চেঙ্গাইলে ইংরেজি মাধ্যমের মডেল মাদ্রাসা গড়ার কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ছয় বছর পার করে এখন বলা হচ্ছে, উলুবেড়ির চেঙ্গাইলের পরিবর্তে পাঁচলার বেলডুবিতে মাদ্রাসার জন্য জমির খোঁজ চলছে!


গত এক দশকে কলকাতায় বসে, জেলা সফরে গিয়ে একের পর প্রকল্পের শিলান্যাস করে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ১০ বছর ধরে পোঁতা শিলায় শ্যাওলা পড়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে তা রূপায়িত করা যায়নি। আবার এমন অনেক প্রকল্প আছে, যেখানে ১০ বছর থেকে ৩ বছর পর্যন্ত শিলান্যাসের পরেও কাজের অগ্রগতির হার ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। 

নবান্ন সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর হাতে শিলান্যাস হওয়া প্রকল্প ধরে তার প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কী না তা আগে যাচাই করা হবে। তার ভিত্তিতে সরকার ঠিক করবে প্রকল্পগুলি ভবিষ্যত। তবে যে সময় শিলান্যাস করা হয়েছিল ওই সময় যা খরচ এখন তা চালু রাখতে হলে ব্যয় বহুগুণ বাড়বে। কোষাগারের সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে এখন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে শিলা পোঁতা প্রকল্পকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়াই শ্রেয় মনে করছে নবান্ন।  
 

 

Comments :0

Login to leave a comment