Mamata Banerjee

বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে মমতার দুর্নীতির দাবি ‘একটু একটু করে’ আঁতুরঘর থেকে চিরকুট হয়েছে

রাজ্য

প্রথমে ছিল আঁতুরঘর। তারপর হলো আলমারি। এখন চিরকুট। 
বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জির দুর্নীতির অভিযোগের রূপান্তর হয়েছে এমনই।
‘চিরকুটে চাকরির’ তালিকা বানানোর দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কাঁধে। কতটা চওড়া সে কাঁধ, তার পর্যালোচনার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০২১-র ৮ ডিসেম্বরে। সেদিন রায়গঞ্জের সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন,‘‘শিক্ষা দপ্তর বড় দপ্তর। কে কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে, আর লোক ঢুকিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক কিছুই হচ্ছে।’’ অর্থাৎ শিক্ষা দপ্তরে অনেকে অনেককিছু করে বেরাচ্ছিল, লোক ‘ঢুকিয়ে বেড়াচ্ছে’ মমতা ব্যানার্জি জেনেছিলেন তখনই। মুখ্যমন্ত্রীর সেই কথার প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু সাংবাদিকদের বলেছিলেন,‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কথায় অবশ্যই সারবত্তা আছে। জেলায় অতীতে যদি কিছু হয়ে থাকে তবে আমরা যথাবিহিত ব্যবস্থা নেব।’’ 
অর্থাৎ ব্রাত্য বসুর প্রতিশ্রুতি ছিল তিনি মমতা ব্যানার্জিরই শাসনে ‘লোক ঢুকিয়ে বেড়ানোর’ বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার। তবে মমতা ব্যানার্জির দায়িত্ব সাঙ্গ হয়েছিল ভাষণে। যেমন হয়। কিছু করেননি ব্রাত্য বসুও। 
তাই এখন বোঝা যাচ্ছে আরও দুর্নীতি হয়েছে। 


সেদিন মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রীর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী, তৎকালীন শিল্প মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ছিল,‘‘মুখ্যমন্ত্রী কোন প্রেক্ষিতে এ কথা বলেছেন, তা না জেনে কিছু বলতে পারব না। তবে শিক্ষা দপ্তর নিশ্চিত ভাবে বড় দপ্তর। সমস্ত খুঁটিনাটি সবসময় সকলের নজরে আসে না।’’
‘খুঁটিনাটি’ মানে কী? চাকরি চুরি? আজ তাই মনে হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি জানতেন। পার্থও। তিনি এখন জেলে।
মমতা ব্যানার্জি দাবি ছিল বামফ্রন্টের সময়কালের দুর্নীতি প্রকাশ করার। এগারো বছর পেরিয়ে গেছে। মমতা ব্যানার্জি কথা রাখতে পারেননি।
দিনটি ছিল ২০১২-র ৩ জানুয়ারি। তখন মুখ্যমন্ত্রী বসতেন মহাকরণে। সেই মহাকরণে মমতা ব্যানার্জি সেদিন বলেছিলেন,‘‘বামেরা দুর্নীতির আঁতুরঘর তৈরি করে গেছে।’’ তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন,‘‘কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। এসব নিয়ে কয়েকটা অডিট করানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রীকে বলেছি, এসব একটু একটু করে প্রকাশ্যে আনতে।’’ 
অর্থাৎ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের কাজকর্ম নিয়ে ‘স্পেশাল অডিট’-র নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ‘একটু একটু করে’ এগারো বছর পার। সেই অডিট রিপোর্ট আসেনি।
বছর দুয়েক পরে সেই অডিটের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কারন —কোটি কোটি টাকার ‘নয়ছয়’, অর্থাৎ দুর্নীতির কোনও চিহ্ন মেলেনি।


বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে ‘চিরকুটে চাকরি’ হত বলে মুখ্যমন্ত্রী আগেও দাবি করেছেন। যেমন, ২০২২-র ১৯ মে তিনি ঝাড়গ্রামে বলেছিলেন,‘‘আগে একটা চিরকুট দিয়ে চাকরি হত। বদলি হত। সিপিএমের ৩৪ বছরে আমি অনেক খোঁজ নিয়েছি। আস্তে আস্তে ‘চ্যাপ্টার ওপেন’ করব। এত দিন ভদ্রতা করে এসেছি।’’
সেই ‘চ্যাপ্টার’ও খুলতে পারেননি মমতা ব্যানার্জি। শুধুই বুলি!
সেই তিনি ২০২২-র ৫ সেপ্টেম্বর হঠাৎ অজুহাতের সুরে জানিয়েছিলেন,‘‘বামফ্রন্ট একটাও আলমারি রেখে যায়নি। আলমারি রেখে গেলে তো কাগজ পাবো।’’ এটা জানাতে একজন মুখ্যমন্ত্রীর প্রায় এক যুগ লাগে? আর এখন হঠাৎ তিনি ‘আলমারি’ পেলেন? ‘চিরকুটের আলমারি?’ বামফ্রন্ট রেখে গেছে? তাহলে উপুড় করা হোক আলমারি — দেখা যাক হঠাৎ খুঁজে পাওয়া আলমারিতে কী আছে? 
আসলে গুজবের কোনও আলমারি থাকে না। মিথ্যার কোনও কাগজ হয় না। 


প্রমাণ? সরকারের কোষাগারের টাকা ঢেলে ২০১১ থেকে একের পর এক কমিশন গড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য বলছে, গত প্রায় ১২ বছরে মমতা ব্যানার্জির সরকার ১৬টি কমিশন এবং এবং ১টি তদন্ত কমিটি বানিয়েছে। তার মধ্যে ছ’টি কমিশন আছে, যেগুলি তৃণমূল শাসনের ঘটনাবলী বিচার বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। সেই ঘটনাগুলি হলো— আমরির অগ্নিকাণ্ড, মগরাহাটের নৈনানে গ্রামবাসীদের নিহত হওয়ার ঘটনা, সারদা কেলেঙ্কারি এবং বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তেহট্টে পুলিশের গুলি চালানো, বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমের মৃত্যুর ঘটনা। এর মধ্যে সারদা কেলেঙ্কারি স্বাধীনোত্তর সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। যেখানে তৃণমূল নেতা, মমতা ব্যানার্জির একাধিক মন্ত্রীর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সেই কেলেঙ্কারির জন্য গঠিত বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশনের রিপোর্ট মমতা ব্যানার্জির সরকার প্রকাশ্যে আনেনি। বসিরহাট দাঙ্গার কমিশনের রিপোর্ট ৬ মাসের মধ্যে পেশ করার কথা ছিল। পেশ করেছেন বিচারপতি সৌমিত্র পাল। কিন্তু প্রায় ৬ বছর কেটে যাওয়ার পরেও তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।


বাকি ১০টি কমিশন তৈরি হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার অথবা সিপিআই(এম)’র ত্রুটি, অন্যায় খুঁজে বের করতে। এর মধ্যে এমন ঘটনাও আছে যেগুলি বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালেরই নয়— যেমন সাঁইবাড়ি এবং বরানগর-কাশীপুর গণহত্যা। এছাড়া বিজন সেতুতে আনন্দমার্গীদের মৃত্যুর ঘটনা, দিনহাটায় গুলি চালানোর ঘটনা, ১৯৯৩-র ২১ জুলাই কলকাতায় পুলিশের গুলিতে উন্মত্ত কংগ্রেস কর্মীদের মৃত্যু, নিউটাউনে ফ্ল্যাট বণ্টন, রাজারহাটের জমি অধিগ্রহণ এবং উপনগরী তৈরি, গড়বেতায় হুল উৎসবের দিন দুর্ঘটনায় আদিবাসী মৃত্যুর মতো ঘটনা আছে। এমপিএস সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে এক বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি বানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও তদন্ত কমিশনেই সিপিআই(এম) কিংবা বামফ্রন্ট সরকারের ত্রুটি, অপরাধ বের করতে পারেনি তৃণমূল সরকার। পারলে নিশ্চই প্রকাশ করতেন মমতা ব্যানার্জি। এই কমিশনের রিপোর্টগুলি যে আলমারিতে তিনি রেখেছেন, সেই আলমারি বামফ্রন্ট নিয়ে গেছে, এমন দাবিও তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়।  
তাহলে আর ভাবের ঘরে ডাকাতি করে লাভ কী? এবার স্বীকার করুন — ‘আঁতুরঘর’ পাইনি। কারন ছিলই না। আলমারি বামফ্রন্ট নিয়ে যায়নি। আর চিরকুট? নেই। নেই। কোনও চিরকুটে চাকরির প্রমাণ নেই। কারন হয়নি — বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে।

 

Comments :0

Login to leave a comment