নাইজারের সামরিক অভ্যুত্থানকে ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মধ্য আফ্রিকায়। যুদ্ধের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই। যদিও আন্তর্জাতিক চাপের ফলে প্রাথমিক ভাবে সেই আশঙ্কায় কিছুটা জল ঢালা সম্ভব হয়েছে। একইসঙ্গে আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় আমেরিকা সহ পশ্চিমী শক্তিগুলির প্রভাব খর্ব হওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে।
২৬ জুলাই মধ্য আফ্রিকার সেহেল অঞ্চলের দেশ নাইজারের ক্ষমতা দখল করেন রাষ্ট্রপতির বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী বা প্রেসিডেনশিয়াল গার্ডের সদস্যরা। সামরিক অভ্যুত্থানের পরে নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন প্রেসিডেনশিয়াল গার্ডের অধ্যক্ষ কর্ণেল আব্দৌর রহমানি চিয়ানি। রাষ্ট্রপতি ভবনেই বন্দী করা হয় রাষ্ট্রপতি মহম্মদ বাজৌমকে।
২৮ জুলাইয়ের মধ্যে নাইজারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেদের হাতে তুলে নিতে সক্ষম হয় চিয়ানি বাহিনী।
প্রসঙ্গত, সাহারা মরুভূমি ও মিশরের দক্ষিণে, এবং কঙ্গোর বৃষ্টিস্নাত অরণ্যের উত্তরে, অতলান্তিক মহাসাগর থেকে লোহিত সাগর অবধি বিস্তৃত এই অঞ্চলকে সেহেল বলা হয়। এই অঞ্চলে বুরকিনা ফাসো, নাইজার, নাইজেরিয়া, মালি, চাঁদ,সুদানের মত একাধিক দেশ এই অঞ্চলে রয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করাচ্ছেন, এই সেহেল অঞ্চলে কয়েক বছরের মধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার হাত বদল ঘটেছে মালি এবং বুরকিনা ফাসোতে। এই গোটা অঞ্চল ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। গত শতাব্দীর পাঁচ এবং ছয়ের দশকে ফ্রান্স এই দেশগুলির স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারপরেও কোনও না কোনও শাসকগোষ্ঠীকে হাত করে সেহেলের ক্ষমতা নিজেদের হাতে টিকিয়ে রাখে ফ্রান্স। একইভাবে অঞ্চলে প্রভাব তৈরি করে আমেরিকাও।
তারফলে ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভ করা নাইজার গত ৬৩ বছরে ৫টি সামরিক অভ্যুত্থানের সাক্ষী থেকেছে। শীতল যুদ্ধের সময়, কমিউনিস্ট প্রভাব ঠেকাতে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সাহেলেও ঢালাও অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে আমেরিকা এবং পশ্চিমী জোট।
নাইজারের পূর্বতন বাজৌম সরকার ফ্রান্স ঘেঁষা বলেই পরিচিত। ফ্রান্সে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের সিংহভাগটাই আসে পরমাণু চুল্লি থেকে। এবং নাইজারের ইউরেনিয়াম খনি সেই চুল্লির প্রায় পুরো জ্বালানিই সরবরাহ করে থাকে।
এর একটা উল্টোদিকও রয়েছে। রুশ সংবাদসংস্থা স্লাভিয়ানগ্রাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, একদিকে যেমন নাইজারের ইউরেনিয়াম থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ফ্রান্সের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে তেমনই তার উল্টোদিকে নাইজারের সিংহভাগ মানুষের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, শতাধিক বছরের ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন নাইজারকে হতদরিদ্র রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। খাতায় কলমে ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হলেও, এখনও নাইজারের মতো পূর্বতন কলোনিগুলিকে নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ফ্রান্সের মত শক্তিগুলি।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, স্বাভাবিক নিয়মেই এই শোষণের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে। এবং তাতে মদত জুগিয়েছে রাশিয়া।
এএফপি, ফ্রান্স ২৪’র মত সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, নাইজারে অভ্যুত্থান সংগঠিত হওয়ার পরে জনতার একটা বড় অংশ রাস্তায় নেমে বিজয় উৎসব পালন করে। সেখানে নাইজারের জাতীয় পতাকার পাশাপাশি রুশ পতাকারও দেখা মিলেছে। একইসঙ্গে ঘেরাও হয়েছে নাইজারে অবস্থিত রুশ ও মার্কিন দূতাবাস। যদিও ক্ষমতাচ্যুৎ রাষ্ট্রপতি বাজৌমের সমর্থনেও মিছিল দেখা গিয়েছে।
নাইজারে আমেরিকা এবং ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ফ্রান্সের ঘাঁটিতে মোতায়েন রয়েছে দেড় হাজারের বেশি জওয়ান। চুয়ানি প্রশাসন ইতিমধ্যেই বার্তা দিয়েছে, পশ্চিমী শক্তির হাতের পুতুল হয়ে থাকতে ইচ্ছুক নন তাঁরা।
রুশ সংবাদ সংস্থা আরটি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরপরেই সক্রিয় হয়েছে পশ্চিমী জোট। সরাসরি নিজেরা সামরিক হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে- এটা বিলক্ষণ টের পেয়েছে ফ্রান্স এবং আমেরিকা। তাই আসরে নামানো হয়েছে পশ্চিমী ঘনিষ্ঠ ’ইকোওয়াস’ জোট বা ‘ইকনমিক কমিউনিটি অফ ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস্’।
নাইজার, মালি কিংবা বুরকিনা ফাসোর মতো দেশগুলি আগে এই জোটে শামিল ছিল। কিন্তু এই দেশগুলিতে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার পরে জোট থেকে বাদ দেওয়া হয় এই দেশগুলিকে। জুলাইয়ের শেষে ইকোওয়াসের তরফে নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি হুমকি দিয়ে বলেন, বাজৌমকে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না করলে নাইজারে সামরিক অভিযান চালাবেন তাঁরা। এর পাল্টা মালি এবং বুরকিনা ফাসোর তরফে ঘোষণা করা হয়েছে, নাইজার আক্রমণকে তাঁদের উপর হামলা বলে বিবেচনা করবে মালি এবং বুরকিনা ফাসো। সেই মতোই সামরিক জবাব দেওয়া হবে। এরপরে খানিক সুর নরম করেছে ইকোওয়াস।
আরটি’র দাবি, ঘুরপথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে পিছু হঠেছে ফ্রান্সও। সরকারি ভাবে প্যারিসের তরফে নাইজার থেকে নাগরিকদের দেশে ফেরানোর কাজ শুরু হয়েছে।
সংবাদ সংস্থা বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকা এবং ফ্রান্স উভয়ের দাবি, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেহেল অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করছে রাশিয়া। এই দেশগুলির দাবি, এর আগে মালি এবং বুরকিনা ফাসোতেও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে সাহায্য করেছে রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন ঘনিষ্ঠ বেসরকারি সামরিক বাহিনী ওয়াগনার গোষ্ঠী। মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, নাইজারের ক্ষেত্রেও ওয়াগনারের ভূমিকা রয়েছে।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে আফ্রিকার দেশগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন পুতিন। মার্কিন আধিকারিকদের অভিযোগ, সেখানে ওয়াগনারের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিল।
Comments :0