‘‘এর মধ্যেই আমাদের থাকতে হয়। কখনও কখনও গন্ধে বমি উঠে আসে। হাওয়ার দমকের সঙ্গে সঙ্গে গন্ধের তারতম্য বাড়ে কমে।’’
কলকাতা বন্দরের যানবাহী বা বাসকুল ব্রিজ পেরিয়ে একটা রাস্তা বাঁদিকে ঢুকে গিয়েছে। বন্দরের সীমানা পাঁচিলের গা ঘেষে। সিধু কানু ডহর। কলকাতা কর্পোরেশনের ৭৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে। সেই রাস্তার ধারে একগুচ্ছ টালির বাড়ি বয়ে চলেছে বন্দরের ‘লেবার লাইনের’ স্মৃতি। বাড়িগুলির উল্টোপারে বন্দরের লাল পাঁচিল।
মঙ্গলবার দুপুর ১টা নাগাদ এখানে দাঁড়িয়েই কথা হচ্ছিল রাধেশ্যাম বাল্মিকীর সঙ্গে। কর্পোরেশনের অস্থায়ী শ্রমিক। তীব্র মাছ ও পাঁক পচা গন্ধে, নাকে রুমাল ঢেকে কথা বলতে বলতে এলাকার ক্ষোভ তুলে ধরছিলেন বাল্মিকী।
বন্দরের বাসকুল ব্রিজ পেরিয়ে রাস্তা ডান দিকে মোড় নিয়েছে। এভিনিউয়ের উপরেই বন্দরের ডেপুটি কমিশনারের অফিস। এই পথ একে বেঁকে গিয়ে উঠেছে বন্দরের সুইং ব্রিজের উপরে। সুইং ব্রিজে দাঁড়িয়ে, তীব্র পচা গন্ধে নাক ঢেকে, দেখতে পাওয়া যায় দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজের তার। আরও দেখা যায় জলের রঙয়ের প্রভেদ। হুগলি নদীর ঘোলাটে জল আর কলকাতা বন্দরের মিশকালো পচা পুঁতিগন্ধময় জল।
রাধেশ্যাম বাল্মিকীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল পান-বিড়ির দোকানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। আশেপাশে অপটু হাতে আঁকা দেওয়াল লিখন, স্থানীয়দের কথায় ‘জয় শ্রী রামের’ ছবি। দোকানির কথায়, ‘‘পচা গন্ধের জলই তো গঙ্গায় ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনও ফর্মুলা টর্মুলা দিয়ে শোধনও তো করতে পারে।’’
কলকাতা বন্দর কেন্দ্রীয় সংস্থা। স্থানীয় কাউন্সিলর, বিধায়করা তৃণমূলের। ধর্মের ধ্বজা তুলে লেবার লাইনের ভোট কুড়িয়েছে বিজেপি। কিন্তু স্থানীয় মানুষের জ্বলন্ত সমস্যায় দেখা নেই দুই ফুলের কারোরই।
বন্দর এলাকার সিআইটিইউ নেতা গৌতম রায়ের কথায়, ‘‘বন্দরের লক গেট খুলে গঙ্গার জল বন্দরে ঢোকানো হয়। সেই জলের সঙ্গে নদীর মাছও ঢুকে পড়ে। এবার সেই জল তো বদ্ধ হয়ে পড়ে। জাহাজ থেকে জলে এসে মেশে পোড়া মোবিল সহ অন্যান্য দূষিত পদার্থ। জলে অক্সিজেনের অভাবে খুব তাড়াতাড়ি মাছ মরে যায়। সেই মাছ পচে, পচে পাঁক হয়, আর দূর্গন্ধে অতিষ্ট হয় গোটা অঞ্চল। এই জিনিস চলতেই থাকে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।’’
একইসঙ্গে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও রাজ্যের পরিবেশ দপ্তরকেও হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
বন্দরের একাধিক অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকের কথায়, ‘‘লকগেট খোলার সময় বন্দরের মিশকালো জলই হুগলি নদীতে গিয়ে মেশে। কোনও শোধনের বালাই নেই। কেন্দ্রীয় সরকার নমামি গঙ্গে প্রকল্প এনেছে গঙ্গায় দূষণ ঠেকাতে। আর সেই কেন্দ্রীয় একটি সংস্থাই বোধহয় পশ্চিমবঙ্গে সবথেকে বেশি গঙ্গাদূষণ করে চলেছে।’’
ওয়াকিবহাল মহলের কথায়, বিশ্বের কোনও আধুনিক বন্দরে পরিশোধন না করে বন্দরের দূষিত জল নদী কিংবা সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়া হয়না। কলকাতা বন্দর গত আর্থিক বছরে ৫০১.৭৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তারপরেও ন্যূনতম পরিবেশ সচেতনতা দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ।
আর সেই সচেতনতার অভাবের খেসারত দিচ্ছেন ৭৬,৭৯ এবং ৮০ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ বাসিন্দারা। তীব্র উৎকট পচা গন্ধের মধ্যেই খিদিরপুর ওড়িয়া হাইস্কুলে প্রতিদিন ক্লাস হয়। ৭৬ নম্বর ওয়ার্ডে বন্দরের পাঁচিলের গা ঘেষেই শুরু হয়েছে মধ্যবিত্ত এলাকা। সেখানেও নিত্যদিনের সমস্যা বন্দরের পচা জলের গন্ধ। পূর্ব রেলের সদর দপ্তর রয়েছে বিএনআরে। সেখানকার কর্মচারী ও আধিকারিকরাও প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ছেন এই পচা গন্ধের ফলে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ একেবারেই যে হাত গুটিয়ে রয়েছে এমনটা নয়। বন্দর এলাকার একের পর এক খেলার মাঠ ঢাকা পড়ছে কংক্রিটে। বন্দর এলাকার জমিগুলির ল্যান্ডলিজ ভ্যালু বাড়িয়েই চলেছে ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্ট। এবং লিজের মেয়াদ ৯৯ বছর থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ বছরে। তারফলে পাততাড়ি গোটাচ্ছে একের পর এক বড় কারখানা। ২০১১ সালের পর থেকে বন্ধ হয়েছে ১৫টি কারখানা। তালিকার সর্বশেষ নাম ব্রিটানিয়া। তলানিতে এসে ঠেকেছে কর্মসংস্থান। আর বন্ধ কারখানার পাশে মাথাচাড়া দিচ্ছে একের পর এক গোডাউন কিংবা বিলাসবহুল গাড়ির সার্ভিস সেন্টার।
Comments :0