Editorial

জনস্পর্ধার মেজাজ বুঝুন মুখ্যমন্ত্রী

সম্পাদকীয় বিভাগ

রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান তিনি। তথ্য প্রমাণ লোপাট করে আসল অপরাধীদের আড়ালের অভিযোগ তাঁরই বিরুদ্ধে। আর জি কর কাণ্ডে ক্ষোভের কেন্দ্রে তিনিই। সেই মুখ্যমন্ত্রীই নেমে পড়লেন ‘প্রতিবাদ’ মিছিলে।
প্রতিবাদীদের শাসাচ্ছেন তিনি। নিজে এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। সোজাসুজি অথবা ঘুরিয়ে। ১৪ আগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখলের’ আগে বলেছিলেন, ভেবেছে বাংলাদেশের মতো করবে! সেই রাতেই গোটা কয়েক দুষ্কৃতী ঢুকে হামলা করেছে প্রতিবাদীদেরই ওপর। ভাঙচুর চালিয়েছে হাসপাতালে। প্রতিবাদী জুনিয়র ডাক্তারদের ধরনা মঞ্চ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বিচারের দাবিতে যাঁরা জড়ো হয়েছিলেন সেদিন রাতে আর জি করের সামনে আক্রান্ত হয়েছেন তারাও। হাসপাতালে হামলার পর পুলিশের টিয়ার গ্যাস। ইট পাথরের বৃষ্টি। আর শুক্রবার হামলাবাজদের মধ্যে ‘ডিওয়াইএফআই’র পতাকা’ দেখে ফেলেছেন মমতা ব্যানার্জি। এর মধ্যে ‘রাম-বাম’, ‘পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা’ বলা হয়ে গিয়েছে। প্রতিটি মন্তব্যে মুখ্যমন্ত্রীর অন্ধ রাগ  ঠিকরে বেরচ্ছে। মিছিলে বেরিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, বলছেন এলাকায় এলাকায় তৃণমুল বাহিনীকে নেমে পড়তে। ন্যায় বিচারের দাবি করতে গিয়েছিলেন যাঁরা,  তাঁদেরই দায়ী করছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বিচারের দাবিতে লড়াইয়ে অটল থাকা জুনিয়র চিকিৎসক-ডাক্তারি পড়ুয়ারা বিবৃতি দিয়ে বলছেন যে হস্টেলে হস্টেলে ভয় দেখানো হচ্ছে। কেবল কলকাতায় নয়, জেলাতেও। আর এসএফআই-ডিওয়াইএফআই সহ বামপন্থী ছাত্র-যুবদের লাগাতার আন্দোলন তাঁদের আশা জুগিয়েছে এই অন্ধকার সময়ে। 
মমতা ব্যানার্জি বলুন বা নরেন্দ্র মোদী, শাসন চালানোর রাজনৈতিক হাতিয়ার ভয় দেখানো। যেমন উত্তর প্রদেশের হাথরসে সাংবাদিককে দেশদ্রোহের দায়ে জেলে ভরে রাখা হয়েছিল। এখানে যেমন কামদুনিতে শাসানো হয়েছিল প্রতিবাদীদের। পার্ক স্ট্রিটে যেমন আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন আক্রান্ত। আর জি করে পরিকল্পিত হামলা আসলে ‘প্রতিবাদীদের সবক শেখানোর জন্য সব ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই রাতের জনজাগরণ আসলে ভয় পাইয়ে দিয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা চলছে দেহ পাওয়ার দিন থেকে। পরিবারকে দেহ দিতে দেরি করা হয়েছে, বলা হয়েছে আত্মহত্যা। আর পুলিশ কমিশনার গোড়ায় সেই তথ্যই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। জনা কয়েক হামলাবাজকে বলছেন হাজার হাজার লোকের তাণ্ডব। মিডিয়াকে আড়াল করতে চেয়েছেন। স্বয়ং কলকাতা পুলিশের কমিশনার নিজে সেই রাতে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে দুষ্কৃতী হামলাকে অন্য খাতে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছেন। তা সত্ত্বেও ভাঙচুরের ভিডিও বেরিয়ে পড়েছে। কারা হামলাবাজ দেখা যাচ্ছে। হামলা হতে দেওয়ায় পুলিশকে ভর্ৎসনা করছে কলকাতা হাইকোর্ট। আদালতে জবাব দিতে পারেনি রাজ্য প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রী দোষী খুঁজছেন, বরাবরের মতো, প্রতিবাদীদের মধ্যে। অথচ চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চই জানিয়েছিল নিয়ম অনুযায়ী লিখিত ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ না দিয়ে আর জি কর হাসপাতালের সেমিনার কক্ষের পাশে দেওয়াল ভাঙা হয়েছে। যে কক্ষে মিলেছিল নির্যাতিতার দেহ। সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হাইকোর্ট দেওয়ার পরই তড়িঘড়ি ঠিক ওই ঘরের পাশেই ‘রেনোভেশন’ কেন, কেন শুরু হয়ে গেল সেই ঘরেরই দেওয়াল ভাঙার কাজ। তার ব্যাখ্যা দেওয়ার ধারকাছ দিয়ে যাচ্ছেন না মুখ্যমন্ত্রী। তথ্য লোপাটের সরকারি উদ্যোগের পর বুধবার মাঝরাতে দুষ্কৃতী তাণ্ডব তথ্য লোপাটেরই বেসরকারি উদ্যোগ। 
মমতা ব্যানার্জির মিছিল প্রতিবাদের জন্য নয়। পালটা জমায়েত দেখানোর জন্য, শক্তির পালটা প্রদর্শন। রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের দায়ী করে একেবারে ডাহা মিথ্যা ছড়ানো, যাতে জমাট বাঁধা আন্দোলনের মধ্যেই কিছু কিছু সংশয় ডানা মেলতে পারে। এই চিত্রনাট্য যদিও রাজ্যবাসীর কাছে নতুন নয়। মমতার কৌশল সত্ত্বেও এদিন ছড়িয়ে পড়েছে দার্জিলিঙের পাহাড়ে মোমবাতি জ্বেলে বিচারের নীরব কিন্তু জোরালো দাবিটি। ছড়িয়ে গেছে গোটা রাজ্যে। মধ্যরাতে যেভাবে দেখা গিয়েছিল প্রতিবাদের জন প্লাবন। ‘মেয়েরা রাতের দখল নাও’ ভাসিয়ে দিয়েছিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিবাদের স্রোতে, মধ্যরাতের সেই  স্পর্ধার মেজাজ নিয়েই গ্রাম-শহর জেগে আছে বিচারের দাবিতে।

Comments :0

Login to leave a comment