নমিতা মাঝি (নাম পরিবর্তিত)
(সন্দেশখালি গ্রামপঞ্চায়েত)
রেগার কাজ তো বন্ধ অনেকদিন। কিন্ত একশো দিনের কাজ করেও কী পেতাম আমরা? মজুরির টাকা একসঙ্গে তুলেছিলাম। প্রায় চার হাজার টাকা পেয়েছিলাম। সাড়ে তিন হাজার টাকা শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের হাতে তুলে দিতে হয়েছিল। না দিলে? পেটাবে। আর কী বলবো! বাচ্চাদেরও রেহাই দেয় না।
আমার স্বামীকে বাড়িতে এসে অন্তত তিনবার মেরেছে। একবার আমি মিছিলে হাঁটবো না সেটা ও শিবু হাজরার বাহিনীকে জানাতে গিয়েছিল। তখন মারলো। একবার রাতে ওকে ফোন করে বললো, আমাকে শিবু হাজরার অফিসে পাঠাতে। একদিন যেতে বাধ্য় হয়েছিলাম। এখন তো আর আমাদের লজ্জা নেই স্বীকার করতে। আমার লুকিয়ে কী হবে। দ্বিতীয় একদিন রাত বারোটায় ডেকেছিল। বলেছিল কলকাতায় নাকি মমতা ব্যানার্জির মিটিংয়ে যেতে হবে, তা নিয়ে আলোচনা হবে। আপনারা তো সব কলকাতার লোকজন। বলুন তো এরকম একটা প্রত্যন্ত দ্বীপে, বাড়িতে স্বামী রয়েছে, ছেলে মেয়ে রয়েছে, তাঁদের সামনে দিয়ে কীভাবে রাত বারোটায় বাড়ির মহিলা যেতে পারে শিবু হাজরার অফিসে? রাতভর ওদের ফূর্তি চলে, মদ চলে। রাতভর বসিয়ে রেখে ভোরবেলায় বাড়ি পাঠাতো।
তো দ্বিতীয়বার স্বামীর ফোনে ডেকেছিল আমাকে। আমি যাইনি। আমার স্বামী বারণ করে দেয় ওদের। সেই রাতেই স্বামীকে ওরা তুলে নিয়ে যায় ঐ অফিসে। মারধোর করা হয়। রাতে বাড়ি ফিরে আসে। অত রাতে কোথায় ডাক্তার দেখাবো।
দেশ কী স্বাধীন হয়েছে? কে জানে, আমরা তো ব্রিটিশ শাসনের থেকেও অধম অবস্থায় আছি। এই যে ১৪৪ ধারা। এখানে দুটো স্কুল। সব বন্ধ। ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতেও ভয় পাচ্ছে। সন্যালী নামলে রাস্তায় মহিলা তো দূরের কথা পুরুষরাও বেরোয় না। ওদের তান্ডব চলে। শাহজাহান যখন গ্রামে আসে মনে হয় সম্রাট আসছে। কত মোটর বাইক। ওর কথায় সব চলে। সন্দেশখালিতে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক দেওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কত খোঁজ নিয়ে দেখুন। পড়াশুনো মাঝপথে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। একে তো অভাবের সংসার। অন্যদিকে আঠারো পেরোলেই বাড়ির ছেলেদের ওরা নিয়ে নেয়। মানে মদ, মেশিন ধরিয়ে দেয়। নিজেরাই তো বলে পড়াশুনো করে কী হবে, টাকা কামাতে হলে আয় সঙ্গে। সুন্দরবনের অবস্থা কী আপনারা ভাবতেও পারছেন না। ভেড়ির টাকায় সব চলছে এখন।
তবে আমরা সত্যি ভয়ে আছি এখনও। রাস্তায় নেমেছে সবাই এটা যেমন ঠিক, তেমনি ভয়ও আছে। পুলিশ তো সব নাম নিয়ে যাচ্ছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে। যারা জেলে আছে তারা যদি পরে ছাড়া পায় তখন কী হবে আমাদের? কটা মিডিয়া আসবে? পুলিশ তো শাহজাহান-শিবুদের বাড়ির চাকরের মত। আমাদের কী হবে?
ভয় আছেই। তবে রোজ মরার থেকে একবারে মরা ভালো। তাই নেমেছি। আমাদের জমি, জায়গা, সংসার সব তছনছ হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা কী পরিবেশে বড় হচ্ছে? সব কথা তো মহিলা কমিশনকে জানিয়েছি আমরা, পুলিশও লিখে নিয়ে গেছে। কী হবে জানি না? মুখ্যমন্ত্রী আমাদের কথা বুঝবেন সেটা ভেবেছিলাম। কিন্তু উনি তো কিছু বলছেন না।
যারা মিছিল করছে সবাই তৃণমূল বিরোধী নয়। সবাই তো এখানে তৃণমূলই করতো। কিন্তু তৃণমূল করলেও মহিলারা ছাড় পায়নি দলের নেতাদের কাছ থেকে। আমরা তো তৃণমূলের মিছিলেই হেঁটেছিলাম। কিন্তু এরা সব হিংস্র জন্তু। টাকা ছাড়া কিছু চেনে না।
Comments :0