মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১৬ সালে চালু করা হয়েছিল দেউলিয়া আইন। কোনো কোম্পানি বা সংস্থা লোকসানে চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেলে ঘোর সঙ্কটে পড়ে পাওনাদার ও কর্মীরা। এমন সংস্থা বন্ধ হলে শুধু কর্মীরা কাজ হারান না, তাদের বেতন ও অন্যান্য খাতে বিপুল অর্থ বকেয়া থাকে। তেমনি ঐ সংস্থাকে যারা ঋণ দিয়েছে সেই সব ব্যাঙ্ক বা আর্থিক সংস্থাও বিপদে পড়ে। আগে এই ধরনের সংস্থাগুলিকে যাতে পুনর্গঠন করা যায় তার চেষ্টা হতো। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হবার ফলে আখেরে পাওনাদার বা কর্মীদের বিশেষ সুবিধা হচ্ছিল না। এই অজুহাতকে সামনে রেখে মোদী সরকার নতুন দেউলিয়া আইন করে যাতে সমস্যা তাড়াতাড়ি মীমাংসা করা যায়। এই দেউলিয়া আইনে পুনর্গঠন করে ফের সংস্থাটি চালু করার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে বরং গুটিয়ে ফেলায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। গুটিয়ে ফেলা মানে সংস্থার যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পদ নিলামে চড়িয়ে বিক্রি করে পাওনাদারদের টাকা মেটানোর ব্যবস্থা। তাছাড়া মোদী সরকার যুক্তি দিয়েছিল কোম্পানি চিরতরে বন্ধ করা বা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হবার ফলে ব্যাঙ্কগুলির বিপুল অর্থ সেখানে আটকে থাকে যা এনপিএ হিসেবে গণ্য হয়। আবার এই বকেয়া অদূর ভবিষ্যতে আদায় হবারও কোনো সম্ভাবনা থাকে না। ফলে ব্যাঙ্কগুলির সমস্যা বাড়ে। অতএব ব্যাঙ্কগুলির পাওনা দ্রুত মিটিয়ে ব্যাঙ্কের আর্থিক অবস্থা চাঙ্গা করার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তৈরি হয় দেউলিয়া আইন। তেমনি কর্মী ও অন্যান্য পাওনাদারদের স্বার্থের কথাও সামনে আনা হয়।
মোদীর বহু প্রচারিত দেউলিয়া আইন পাশের পর ৬বছর কেটে গেছে। এই কয় বছরের হিসাবের খাতা মেলাতে গিয়ে দেখা গেছে ঘোষিত লক্ষ্যের কিছুই অর্জন করা যায়নি। পাওনাদারদের কিছুই প্রায় জোটেনি। মাঝখান থেকে দেউলিয়া সংস্থার সম্পদ জলের দরে কিনে লাভবান অন্যান্য চালু সংস্থা।
২০২২সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ২৬৭টি দেউলিয়া আবেদনের ক্ষেত্রে পাওনাদারদের দাবি ছিল ১৪লক্ষ ৪০হাজার কোটি টাকা। বাস্তবে সংস্থাগুলির মূল্যায়ন করে দেখা গেছে মোট সম্পদ মূল্য মাত্র ১ লক্ষ ৭০হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ১৩লক্ষ কোটি টাকা কম। তার মানে পাওনাদাররা কোনদিন তাদের এই বকেয়া ১৩লক্ষ কোটি টাকা ফেরত পাবে না। ব্যাঙ্কগুলি এই বিপুল পরিমাণ অর্থ চিরতরে হারাবে। এই প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকবে না। এইভাবেই সরকারি মদতে শিল্পবাণিজ্য সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্কঋণ দিয়ে যাবে ফেরত দেবার ক্ষমতা যথাযথভাবে যাচাই না করে। তারপর এক সময় সংস্থাগুলি লালবাতি জ্বালিয়ে ব্যাঙ্কের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে বিপুল অনাদায়ী ঋণের বোঝা। অন্যদিকে নিলামের চক্করে পড়ে অনেক সম্পদ বিক্রি হয়ে যায় কম দামে।
বেসরকারি মালিক তথা বিনিয়োগকারিদের সহজে অতি মুনাফার স্বার্থে সরকারি ছাড়পত্র দেবার প্রক্রিয়া সহজ ও সরল করার নামে (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) এমন সব নতুন নতুন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে যাতে সংস্থার ভবিষ্যত যথাযথ যাচাই হয় না। কোনো সংস্থা যত ঋণ চায় তা ফেরত দেবার সামর্থ যাচাই ঠিকঠাক না হলে পরে ব্যাঙ্ককে পস্তাতে হয়। তেমনি সরকারের তরফেও চাপ থাকে দ্রুত ঋণ অনুমোদনের। আবার সরকার প্রতিনিয়ত যেভাবে সাফল্যের ঢাক পেটাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে অতি উজ্জ্বল রঙিন ছবি আঁকছে তাতে এমন একটা আবহ তৈরি হয় যেন ব্যবস্থা চালু করলেই নিশ্চিত লাভ। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক মালিক বিপুল ঋণ নিয়ে অন্য খাতে টাকা সরিয়ে সংস্থাকে রুগ্ণ করে দেউলিয়ার দিকে ঠেলে দেয়। ফলে লোকসান গুণতে হয় ব্যাঙ্ককে। আদতে ব্যাঙ্কের টাকা দেশের সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চয়। দেউলিয়া কারবারে শেষ বিচারে জনগণের অর্থই লুট হয়ে যাচ্ছে।
Comments :0