রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত সরাসরি হিংসার প্ররোচনা দিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘হিন্দু সমাজ যুদ্ধে রয়েছে, যুদ্ধের সময়ে আগ্রাসী মনোভাবই থাকে’। নাম করেই মুসলিম জনসমষ্টিকে হুমকিও দিয়েছেন তিনি। সঙ্ঘের পত্রিকাগুলির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভাগবত ‘দেশের মধ্যের শত্রুদের’ বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধের’ ডাক দিয়েছেন।
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো বুধবার ভাগবতের এই জঘন্য মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করে বলেছে, তাঁর এই বক্তব্য ভারতের সংবিধান, সকল নাগরিকের সমানাধিকার, আইনের শাসনের প্রতি খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ। তিনি মুসলিম জনসমাজকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, নিরাপদে থাকতে হলে তাদের ‘প্রাধান্যের’ ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে। তথাকথিত ‘হিন্দু সমাজের’ আগ্রাসী মনোভাবকে বৈধতা দিতে তিনি তাঁর ধারণাসঞ্জাত ঐতিহাসিক অন্যায়ের কথা বলেছেন, হিন্দু সমাজ ‘যুদ্ধে রয়েছে’ বলে ঘোষণা করেছেন। ভাগবত কার্যত ভারতীয় নাগরিকদের একাংশের বিরুদ্ধে ধর্মীয় পরিচিতির বিরুদ্ধে হিংসার ডাক দিয়েছেন।
পলিট ব্যুরো বলেছে, বাস্তবে ‘হিন্দু সমাজ’ নয়, আরএসএস’র মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ও ভাগবতের মতো নেতাদের মদতপ্রাপ্ত হিন্দুত্ব বাহিনী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকারের ওপরে বিভিন্ন স্তরে অবিরত আঘাত নামিয়ে আনছে। সংখ্যালঘু অংশের মধ্যে আতঙ্কের মনোভাব তৈরি করছে। আরএসএস’র প্রাক্তন নেতা হেগড়েওয়ার ও গোলওয়ালকারের সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত লেখনীতে যে ঘৃণার কথা বলা হতো ভাগবতের বিবৃতি তাকেই নতুন করে বলেছে। তাঁরাও বলতেন, মুসলিমরা ভারতে বাস করতে পারবে একমাত্র যদি অধীনতা স্বীকার করে নেয়।
পলিট ব্যুরো বলেছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের মৌলিক সাংবিধানিক মূল্যবোধের ওপরে এই জাতীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে সমস্ত দেশপ্রেমিক মানুষের ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
ভাগবত সঙ্ঘের পত্রিকা ‘অর্গানাইজার’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, ‘হিন্দু সমাজ ১ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধে রয়েছে। বিদেশি আক্রমণ, বিদেশি প্রভাব, বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এই লড়াই চলছে। সঙ্ঘ এই লড়াইয়ে সমর্থন জুগিয়েছে। আরও অনেকে জুগিয়েছেন। তার ফলে হিন্দু সমাজ এখন জেগে উঠেছে। যুদ্ধরত মানুষের পক্ষে আগ্রাসী হওয়া স্বাভাবিক’। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আক্রমণের বৈধতা দিয়ে ভাগবত বলেছেন,‘ গীতায় বলা রয়েছে আলস্য ছেড়ে লড়াই করো। সকলের পক্ষে এই নির্দেশ মানা সম্ভব নয়। কিন্তু সঙ্ঘের মাধ্যমে কিছু মানুষ সামাজিক জাগরণের কাজ করেছে। এই সামাজিক জাগরণের কাজ শুরু হয়েছে প্রথম আক্রমণকারী আলেক্সান্দারের সময় থেকে। যুদ্ধের সময়ে অতি ব্যগ্রতা স্বাভাবিক। বাঞ্ছিত না হলেও স্বাভাবিক।’
হিন্দুত্ববাদীদের মূল ধ্বনিই হলো ‘ভেতরের শত্রুদের’ বিরুদ্ধে লড়াই করা। ভাগবতের কথায় তার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। তিনি বলেছেন,‘ এই লড়াই বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে নয়, ভেতরের শত্রুর বিরুদ্ধে। হিন্দু সমাজ, হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতিকে রক্ষা করার লড়াই। বিদেশি দখলদাররা আর নেই কিন্তু বিদেশি প্রভাব ও ষড়যন্ত্র রয়ে গেছে।’ তথাকথিত ‘হিন্দু সমাজ’ খাড়া করতে সংখ্যালঘুদের ‘শত্রু’ বলে খাড়া করা ও তাদের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার করা সঙ্ঘের চিরাচরিত কায়দা। ভাগবত মুসলিমদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেই প্রচারের কিছু অংশকে ফের সামনে এনেছেন। তিনি বলেন, ‘হিন্দুস্তান হিন্দুস্তানই থাকবে। আজকের ভারতে বাস করা মুসলিমদের কোনও ক্ষতি হবে না। যদি তারা নিজেদের ধর্ম ধরে রাখতে চায় তা করতে পারে। যদি তারা তাদের পূর্বপুরুষের ধর্মে ফিরে আসতে চায় তা-ও পারে। ইসলামের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু একই সঙ্গে মুসলিমদের প্রাধান্যের মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। এই কারণেই জনসংখ্যায় ভারসাম্যহীনতা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তা নিয়ে এখনও আমাদের চিন্তা করতে হবে। শুধু জন্মহার নয়, ধর্মান্তরকরণ এবং অবৈধ অভিবাসীরা এই ভারসাম্যহীনতার প্রধান কারণ। এইসব আটকাতে পারলে ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা যায়।’ এমনভাবে ভাগবত দাবি করেছেন যেন তিনি বা সঙ্ঘই মুসলিমরা ভারতে কীভাবে থাকবে তা নির্ধারণ করার মালিক।
এদিন আগরতলায় সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, ভাগবতের বক্তব্য বড় হিংসার বার্তা দিচ্ছে। অত্যন্ত বিপজ্জনক বার্তা। ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে দাঙ্গাহাঙ্গামা, বিষ ছড়ানো, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ছাড়া বিজেপি’র কোনও উপায় নেই। সঙ্ঘ-বিজেপি ‘নফরত মেশিন’। মুসলিম, খ্রিস্টান, কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে, তেমন হলে দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা করাই এদের লক্ষ্য। ইয়েচুরি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জি-২০’র বিষয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলছেন। বসুধৈব কুটুম্বকম আওড়াচ্ছেন। দেশের বাইরে গিয়ে তিনি গান্ধী, দেশের ভেতরে গডসে।
Comments :0