MUKTADHARA GOLPO / SANJBATI PAL

মুক্তধারা গল্প / মাসুদের রথ

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA   GOLPO  SANJBATI  PAL 26 JUNE

গল্প

মাসুদের রথ
সাঁঝবাতি পাল


পায়ে খুব লেগেছে রে দাদা"
"কিছু হবে না,গিয়ে জল নিয়ে নিবি"
মাসুদ অল্প পা ঘষে হাঁটতে থাকে।ভয় পেয়েছিল ভীষণ,তবে এখন মনটাও বেশ খারাপ।দেখায় হলো না কিছু...কত কি শুনলো,রথ বেরোয়,ভেতরে নাকি ঠাকুর থাকে..তাতে  লোকজন চেপেও থাকে..অনেক লোক মিলে আবার সেই রথ টানে...এই মোটা দড়ি! সে কোনোদিন আসেনি রথ দেখতে,মা-বাবা আসতো..দাদাও মাঝে মাঝে...সাহায্য করে দিতো।পাড়ায় ওদের ছোটো মিষ্টির দোকান।বিক্রি হয় না বললেই চলে..তাছাড়া দুধ কেনার ক্ষমতা নেই মাসুদদের ।তাই চিনির গোলা বিক্রি না হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।তবে এই রথের মেলায় সব বারেই ওর বাবা একটা ছোটো দোকান দেয়...জিলিপি,পাঁপড়। এবারে বাবা খুব অসুস্থ।মা বললো দাদার সাথে যেতে।তবে এবারই যে কেন এরকম হলো...সেই সবে উনুন জ্বলেছে।মাসুদ দেখছিল পাশের দোকানের লোকটা অনেক্ষন দেখছিল,তারপরেই উঠে গেল হঠাৎ।

খানিক পরেই বেশ কিছুজন লোক এলো..দাদাকে বললো..."এই যে ভাই...এখান থেকে দোকানটা সরাতে হবে যে!"
দাদা জিজ্ঞেস করেছিল "কেন?"
পেছন থেকে সাদা পাঞ্জাবি পরা একটা লোক বললো..."কেন কি রে!? ঈদে আমরা গেছলাম তোদের ওখানে পাঁপড় বেচতে?!''
দাদা বলল,"কটা পয়সা বিক্রি হলে উঠে যাবো"
হঠাৎ ওই সাদা পাঞ্জাবি পড়া লোকটা "বলে তো দিলাম...এত কথা কিসের রে!"বলে এগিয়ে এসে গলা ধরে দাদার...মাসুদ আঁতকে ওঠে,কিছু না ভেবেই হঠাৎ এগিয়ে যায় লোকটা এমন ঠেলা মারে,পাশের বাঁশটাই পা লেগে রক্তারক্তি।কে জানে কি হতো,সঙ্গে সঙ্গে দাদা বললো..."চলে যাচ্ছি চলে যাচ্ছি"...বাকি লোকগুলো থামালো সাদা পাঞ্জাবিকে।মাথা তুলে মাসুদ দেখলো তাদের চারপাশে প্রচুর লোকজন,আসতে আসতে ওরাও এগোলো সামনে।


দাদা কোনো কথা বলছেনা,চুপচাপ হেঁটেই যাচ্ছে।কথা বলতেই ভয় লাগছে মাসুদের।তবু জিজ্ঞেস করে দাদাকে..."ওই লোকগুলোকে তুই দেখেছিস আগে? কই বাবাকে তো ওরা বারণ করেনি কোনোদিন?"
-"এবারে কমিটিতে নতুন লোক এসেছে অনেকে,আগের লোকেরা নেই...বাবা এলেও বারণ করত।"
মাসুদ বোঝার চেষ্টা করে।তবু বুঝতে পারেনা কিছু।ও জানে ওরা মুসলিম।তবে গেলবার দুর্গা পুজোয় বাবা ওকে প্যান্ট কিনে দিয়েছিল,এই সরস্বতী পুজোয় ওরা ইস্কুল থেকে গেছল পাশের বাগানে খিচুড়ি খেতে,তারপর রোজ সন্ধ্যায় মা-ও তো পাশের বাড়ি যায়,টিভিতে "রাধা কৃষ্ণ" দেখতে...এরকম তো কেউ বলেনি...
মাসুদের দাদু নাকি খুব পড়াশোনা জানতো।একসময় পড়াতো ইস্কুলে।দাদু বলতো..."একই বৃন্তে দুইটি কুসুম,হিন্দু-মুসলমান"...মাসুদ ভাবতো কুসুমটা তো সে জানে,ওই ডিমের হলুদটা।বৃন্তটা কি? পরে দাদুই বলেছিল, কুসুম মানে ফুল...একই বৃন্তে যেমন দুইটা ফুল থাকে,যেমন হিন্দু আর মুসলমান দুই ভাই।তাহলে যে!


মনটা আবার যেন খারাপ হয়ে যায়।একবার দেখা যেত যদি রথটা!ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বেশ হল্লা শোনা যায়। মাসুদ তাকিয়ে দেখে মোড়ের মাথায় ওর বয়সি নয়,দশজন...কার হাতে থালা,লাঠি দিয়ে বাজনা বাজাচ্ছে।কার হাতে ছোটো ঘন্টাও আছে একটা।একটু কাছে আসতে দেখে ও মা ওই তো রথ! দড়িও আছে,ওরা টানতেই ছোট ছোট চাকায়  রথ গড়িয়ে চলছে বেশ। মাসুদকে দেখেই ওরা ডাকলো।
মাসুদ হাঁ করে দেখছিল..ওই তো ওপরে চূড়া।তাতে পতাকাও আছে একটা,ভেতরে ওই যে ঠাকুর।ঠিক মা যেরকম বলেছিল। হঠাৎ ডাক শুনে ছুটে যেতেই একটা মেয়ে  ওর আর দাদার হাতে দুটো নকুলদানা দিয়ে বললো.."নাও,প্রসাদ,নমো করে খাবে" বেশ ভালো তো..মাসুদ আগে খায়নি এটা...দাদাও কি ভেবে ব্যাগ থেকে পাঁপড় বের করে এগিয়ে দিল। মেয়েটা বলে উঠলো"রথের পাঁপড়!" সবাই তো অবাক...মাসুদের থেকেও বেশি।এর মধ্যেই কে যেন চেঁচিয়ে উঠলো "ওগুলো পৌঁছে খাবো দাদা, তাড়াতাড়ি দড়িটা ধর,ঠাকুর মাসির বাড়ি পৌঁছনোর আগে বেশিক্ষন থামতে নেই।" ব্যাপারটা বেশ বুঝতে পেরে মাসুদ ভীষণ আনন্দে টান মারলো দড়ি ধরে।
আর কি...রাস্তাটা যদিও উঁচুনিচু..তবুও টলমলে রথ,সুন্দর এগিয়ে চলল ওদের টানে,গন্তব্যের দিকে...

সাঁঝবাতি পাল
উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ
সত্যবানপল্লী, ঝাড়গ্রাম, জঙ্গল মহল।

Comments :0

Login to leave a comment