এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় নতুন করে আরও ১৬৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। এই নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে এখন পর্যন্ত মোট ৫৪৪ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল ইডি। মূলত তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ, নিয়োগ দুর্নীতির চক্রের অন্যতম মিডলম্যান প্রসন্ন রায়, তার স্ত্রী ও তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সংস্থার নামে হোটেল-রিসর্ট ও অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি মিলিয়েই নতুন করে এই ১৬৩ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি।
কী নেই সেই বাজেয়াপ্তের তালিকায়?
প্রসন্ন রায়ের মোট পাঁচটি হোটেল ও রিসর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। হাওড়ার শ্যামপুরে চলন্তিকা রিসর্ট, সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল রিসর্ট, দীঘায় হোটেল মিলি, জলপাইগুড়িতে হোটেল মূর্তি, আলিপুরদুয়ারে বাম্বু ভিলেজ রিসর্ট- এসবই ছিল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ মিডলম্যান এই প্রসন্ন রায় ও তার স্ত্রীর মালিকানায়। এই পাঁচটি হোটেল ও রিসর্ট সিজ করা হয়েছে। নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রভাবশালীদের টাকাই খেটেছে এখানে। শুধু তাই নয়, প্রসন্ন রায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা শ্রী দূর্গা ডিলকম প্রাইভেট লিমিটেডের নামে ১২টি ফ্ল্যাট, অফিস, দোকান ও ৬৪টি প্লটও ছিল। তাও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রসন্ন রায়ের স্ত্রী কাজল সনি রায়ের নামে থাকা ১৭টি ফ্ল্যাট, অফিস, দোকান ও ৩৪টি প্লটও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
ইডি’র বাজেয়াপ্তের তালিকা দেখে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সামান্য এক মিডলম্যান, যে মূলত নিয়োগ দুর্নীতিতে দালালের ভূমিকা পালন করেছিল তার এই বিপুল সম্পত্তি যদি হয়ে থাকে, তবে মূল চক্রীদের সম্পত্তির বহর কত হতে পারে? ইডি’র দাবি, হোটেল, রিসর্ট, এই একাধিক ফ্ল্যাট, বাড়ি, জমি— বিপুল এই সম্পত্তি আসলে হাজার হাজার যোগ্য বঞ্চিতদের চোখের জলে বিনিময়ে, অযোগ্যদের কাছ থেকে তোলা কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে।
কে এই প্রসন্ন রায়? শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডেই দু’বছর আগে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই প্রসন্ন রায়কে গ্রেপ্তার করেছিল। পরে ইডি’ও তাকে হেপাজতে নেয়। বর্তমানে জেল হেপাজতে আছে। প্রসন্ন রায়ের বিরুদ্ধে মন্ত্রী সহ প্রভাবশালীদের হয়ে চাকরি বিক্রির কারবার চালানোর সরাসরি অভিযোগ। এই মিডলমন্যান ছিলেন পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ। রীতিমতো ‘ক্যান্ডিডেট’ জোগাড় করে টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কাজেই যুক্ত ছিলেন ধৃত প্রসন্ন রায়। বিনিময়ে এই মিডলম্যান বা নিয়োগ কাণ্ডে অভিযুক্ত দালাল প্রসন্ন রায় যে সম্পত্তি করেছেন, তাতে চক্ষু চড়কগাছ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকদের। নারকেলডাঙায় একটি ছোট্ট বাড়িতে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন প্রসন্ন রায়। সেখান থেকে এখন কয়েকশো কোটির সম্পত্তির মালিক। একাধিক দামি গাড়ি। একাধিক জমি। এই ব্যক্তির গাড়ির ব্যবসাও ছিল আগে। এসএসসি ভবনে ভাড়া খাটত সেই গাড়ি। প্রসন্নর গাড়ি চড়তেন শান্তিপ্রসাদ সিনহাও। নিউটাউনে একটি আবাসনে ফ্ল্যাট আছে প্রসন্ন রায়ের। শান্তিপ্রসাদ সিনহার সঙ্গে ধৃত আরেক মিডলম্যান প্রদীপ সিংয়েরও ঘনিষ্ঠ ছিল। সামগ্রিক দুর্নীতির চেহারা এতটাই যে একজন মিডলম্যানেরই অ্যাকাউন্টে ৭২ কোটি টাকা!
তদন্তকারী আধিকারিকদের কথায়-দুর্নীতির বহর এতটাই যে একটা মিডলম্যানেরই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। তাহলে যাদের কাছে টাকা পৌছাতো, তাঁদের সম্পত্তির চেহারা কী হতে পারে? শুধু তাই নয়, উত্তরবঙ্গে চা-বাগানের মালিকও বনে গিয়েছিলেন প্রসন্ন রায়। নিয়োগ দুর্নীতির টাকা খেটেছিল চা-বাগানে। নাগরাকাটা থানা এলাকায় বামুনডাঙা চা বাগান ও তার ডিভিসন টুন্ডু চা বাগান কিনেছিল এই ব্যক্তি। যদিও সেই বাগান এখন বন্ধ।
এর আগে গত জুন মাসে নগর দায়রা আদালতে দায়ের করা রিপোর্টে ইডি জানিয়েছিল, নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত শাসক তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ মিডলম্যান প্রসন্ন রায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ছয় বছরে ঢুকেছিল ৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৭২ মাসে ৭২কোটি টাকা। চাকরি বিক্রির টাকাই প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ এই মিডলম্যানের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছিল বলেই দাবি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র তরফে এদিন বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, নবম-দশম-একাদশ-দ্বাদশে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে এর আগে ২৩০ কোটি ৬লক্ষ টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতিতে ইতিমধ্যে ১৫১ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। এবার এসএসসি দুর্নীতিতে নতুন করে ১৬৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে শুধুমাত্র এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে এখনও পর্যন্ত ৫৪৪কোটি ৮লক্ষ টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে। সরকারি মদতে শাসক তৃণমূলের নেতাদের মাধ্যমে নিয়োগ দুর্নীতির আসল চেহারা কী তা বাজেয়াপ্তের তালিকাই স্পষ্ট।
544 crore property seized by ED in recruitment corruption
নিয়োগ দুর্নীতিতে ৫৪৪ কোটির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ইডি’র
×
Comments :0