ANAYAKATHA — PALLAV MUKHAPADHAYA / MUKTADHARA - 26 November

অন্যকথা — রবীন্দ্রনাথের সম্প্রীতিভাবনা / মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

ANAYAKATHA  PALLAV MUKHAPADHAYA  MUKTADHARA - 26 November

মুক্তধারা

অন্যকথা

রবীন্দ্রনাথের সম্প্রীতিভাবনা
পল্লব মুখোপাধ্যায়

১৯০৫ সালের ইংরেজের ব্যর্থ বঙ্গ বিভাজন প্রত্যক্ষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
সেসময় গোটা বাংলার হৃদয়মথিত প্রেক্ষণ ও প্রতিবাদ, প্রতিরোধের সমান্তরালে
একাধিক প্রবন্ধে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ
করেছিলেন তিনি। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, সংগীত, নাটকে নির্দেশ করেছিলেন মিলন ও
সম্প্রীতির সূত্র।
রবীন্দ্র প্রয়াণের ছয় বছরের মধ্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চক্রান্ত দেখল গোটা দেশ।
বিদায়লগ্নে ইংরেজ মরণ কামড় দিয়ে গেল। অখণ্ড দেশকে খণ্ডিত করে ধৰ্ম ও
সম্প্রদায়ের নামে এঁকে গেল এক সুদূরপ্রসারী বিভেদের ক্ষতচিহ্ন। ভাগাভাগি এবং
ভাঙাভাঙির খেলায় বিষিয়ে উঠল দেশবাসীর মন। যে বিষবৃক্ষ বপন করে গিয়েছিল ইংরেজ
তা আজ মহীরুহে পরিণত। সর্বগ্রাসী মৌলবাদ এখন নিছক আচারসর্বস্বতায় সীমিত
নেই। ক্ষমতার অলিন্দে তার দৃপ্ত পদচারণা উন্মার্গগামী উগ্র জাতীয়তাবাদে।
রবীন্দ্রনাথের মিলন ও সম্প্রীতিবোধ বিশ্বমানবতাবোধের প্রতিভাসে অমলিন।
'মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে বিশ্বাস করাকে' রবীন্দ্রনাথ 'অপরাধ'
বলে মনে করতেন।


মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর রবীন্দ্রনাথ চিরদিন গুরুত্ব দিয়েছেন। জীবনের
শেষদিন পর্যন্ত মানুষকে ভালোবেসেছেন। তাঁর কাছে মানবধর্মই ছিল শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম।
এই প্রজ্ঞার কারণেই রবীন্দ্রনাথ চিরকাল প্রাসঙ্গিক। কী নিপুণ দক্ষতায় তিনি
ধরতে পেরেছিলেন যে ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রবহমান ধারায় দ্বন্দ্ব থাকলেও
মূল সুরটি সম্প্রীতির। ভারত ইতিহাসের মূলগত বৈশিষ্ট্য যে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’
তা যেমন ধরতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তেমনই বুঝেছিলেন ভারতীয় ঐতিহ্যের মূল
প্রণোদনা ঐক্যমূলক।
এই যে ঐক্যবোধ, এক-কে প্রত্যক্ষ করা ও ঐক্যবিস্তারের চেষ্টা, রবীন্দ্রনাথের
মতে, তা ভারতের স্বভাবের মধ্যেই নিহিত। কবির ইতিহাস চিন্তা অনুধ্যান করলে
নিঃসংশয়ে স্বীকার করতেই হয় যে ইতিহাস চর্চা ও নিজ অভিজ্ঞতার নিরিখে
সঙ্গতভাবেই রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, ভারতের ইতিহাসের মূল সুর, ভারতের হৃদয়ের
মর্মবাণী সংঘর্ষ নয়, সামঞ্জ্যস্য। ভারতবর্ষ নানা জাতি, ভাষা, ধৰ্ম, মত মিলে বহুধা
সংস্কৃতির দেশ হিসেবে 'মহামানবের সাগরতীর' হতে চেয়েছে। এই সময়ে অত্যন্ত
প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথের সম্প্রীতিভাবনা ইতিহাসাশ্রিত, প্রামাণিক তথ্য সমর্থিত।

এর নিরিখেই মৌলবাদী শক্তির হানাহানি, সাম্প্রদায়িক হুঙ্কার কিংবা উগ্রজাতীয়বাদী
স্লোগানের অসারতা প্রতিপন্ন হয়।
রবীন্দ্রনাথের স্থির প্রতীতি ছিল বিরোধ-ব্যতিক্রম- বৈপরীত্য-সংঘর্ষ সত্বেও
ভারতের পথ ঐক্য ও শান্তির। তা না হলে বিবিধের মাঝে মিলনের বৈশিষ্ট্য সম্ভব হত না। 
সম্প্রীতির আরও বিশদ প্রেক্ষিত মৈত্রী, বন্ধুত্ব, সংহতি, ধর্মনিরেপেক্ষতা। ভুলে
গেলে চলবে না যেখানে 'বিচিত্র জাতি' আছে, মানুষের মধ্যে পার্থক্য বা বিরোধ আছে
সেখানে সংহতির জন্য মূঢ়তা নয়, সতর্কতা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'ভারতবর্ষ
বিসদৃশকেও সম্বন্ধ বন্ধনে বাঁধিবার চেষ্টা করিয়াছে।'
'ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা' শীর্ষক রচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, '...বহুর মধ্যে
আপনাকে বিক্ষিপ্ত করিয়া ফেলা ভারতবর্ষের স্বভাব নহে, সে এক-কে পাইতে চায়
বলিয়া বাহুল্যকে একের মধ্যে সংযত করাই ভারতের সাধনা।...' রবীন্দ্রমানসে
সম্প্রীতি চেতনার ফলে স্পষ্ট হয় ঐক্যমূলক বোধই ভারত ঐতিহ্যের নিয়ন্তা ও
চালিকাশক্তি। এরই সমান্তরালে তাঁর চিন্তা যে স্বাজাত্যবোধের পরিধি অতিক্রম করে
বিশ্ববোধের ভূমিতে উপনীত তারও মুলে রবীন্দ্রনাথের সম্প্রীতিচেতনা। তিন দশকেরও
আগে দেশের ধৰ্মনিরপেক্ষতার ওপর আঘাত আসার দিনটি সমাগত। তাই রবীন্দ্রনাথের
সম্প্রীতি চেতনা ও ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া সমকালীন পরিস্থিতির নিরিখে অত্যন্ত
জরুরি ও প্রাসঙ্গিক।


 

Comments :0

Login to leave a comment