মুক্তধারা
অন্যকথা
সভ্যতা ও গণিত জ্ঞান
শুভ্রদীপ পাল চৌধুরী
মহেঞ্জোদড়ো-হরপ্পার কথা আমরা ইতিহাস বইতে পড়েছি। এই সভ্যতার বিবরণগুলি পড়তে আমার খুব ভাল লাগে। ইতিহাসবিদরা এই দুই জায়গা থেকে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শগুলি বিচার বিশ্লেষণ করে প্রাক-বৈদিক ভারত বর্ষের নাগরিক জীবন, খাদ্যাভ্যাস, জামাকাপড়, শিল্প, বাণিজ্য, জ্ঞান-বুদ্ধি প্রভৃতি সম্বন্ধে, এক কথায় সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে বেশ কিছুটা ধারণা ও সিদ্ধান্ত আমাদের জানিয়েছেন।
তাদের বানানো নগরগুলি ছিল বেশ সুপারিসর (বড় মাপের), অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও স্বাস্থ্যসম্মত। সিন্ধুবাসীরা নগরের আবর্জনা ও ময়লা জল নিকাশের যে ব্যবস্থা করেছিল তা এককথায় তুলনাহীন। প্রতিটি বাড়ি এবং প্রতিটি পথ ছিল নালা যুক্ত, খোলা নালাগুলি মাটির নীচে প্রায় দু’ফুট ব্যাসের নালার সাথে যুক্ত। আবর্জনা ফেলার জন্য পথের ধারে ধারে পাত্র রাখা থাকত। ময়লা জল, আবর্জনা নিক্ষেপের শেষ ব্যবস্থা ছিল নগরের বাইরে গভীর খাদ। নগরগুলি এক প্রান্ত থেকে আপর প্রান্ত পর্যন্ত কতগুলি সুপ্রশস্ত রাজপথ দ্বারা নানারকমের আয়তাকার পল্লীতে বিভক্ত ছিল।
রাস্তার দু’পাশে থাকত ছোটবড় বাড়ির শ্রেণি। পোড়া ইটের বাড়িগুলি নানারকমের মাপের, মসৃণ মেঝে, কোনটা একতলা, কোনটা একাধিক তলা। প্রায় সব বাড়িতেই দেখা যেত প্রশস্ত দরজা-জানালা, অনুচ্চ পাচিল দিয়ে ঘেরা ও খোলা প্রাঙ্গণ। প্রাসাদের মত বাড়িগুলিতে ছিল বাগান ও উঁচুউঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা। প্রতিটি গৃহে কুয়ো এবং স্নানের কুয়ো। আবার সবার জন্য নগরের মধ্যে ছিল বিশাল স্নানাগার এবং সাঁতার কাটার জায়গা। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে ছিল পুরবাসীদের সভাগৃহ বা মন্দিরের মত কতগুলি কক্ষ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কয়েকটি সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে। অন্য কতগুলি নিদর্শন থেকে মৃতদেহ দাহ করার প্রথাও ছিল বোঝা যায়।
সিন্ধু সভ্যতার অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল ছিল কৃষি, পশুপালন ও নানাবিধ শিল্প। কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে গমই ছিল প্রধান, কিন্তু যব ও নানা রকমের ফলও উৎপাদন হত। খাদ্য তালিকায় ছিল মাছ-মাংস-ডিম। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পাওয়া নানা রকমের মশলা, নানা আকারের বাসনপত্র ও গৃহস্থলী সামগ্রী পাওয়া গেছে। সিন্ধুবাসীরা তুলা ও পশমের জামাকাপড় ব্যবহার করত। স্ত্রী-পুরুষ সকলেই ছিল অলংকার প্রিয়। সোনা-রূপা-গজদন্ত অলঙ্কার হিসাবে ব্যবহৃত হত। প্রাক বৈদিক সিন্ধু উপত্যকার ভারতীয়রা রসায়ন, পূর্তবিদ্যা, কারিগরি বিদ্যায় প্রভূত পারদর্শিতা অর্জন করেছিল।
কিন্তু সে যুগের গাণিতিক উৎকর্ষতা বা তৎপরতার কোনও সুস্পষ্ট সাক্ষর বা সুনিশ্চিত প্রমাণ সম্পর্কে এক কথায় উত্তর দেওয়া যাবে না। এর কারণ প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাব, দ্বিতীয় কারণ রয়েছে গণিতের চরিত্রের মধ্যে। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিশেষত রসায়ন, ধাতু নিষ্কাসন, কারিগরির প্রমাণ সহজে পাওয়া যায়, কিন্তু গণিতের উৎকর্ষতা বিচারে এই সুবিধা নেই। বিশুদ্ধ গণিত ফলিত নয়, তত্ত্বপ্রধান বা থিওরিটিক্যাল। গণিতের আত্মপ্রকাশের কোনও সরাসরি পথ নেই, গণিতের বই-পুস্তক ছাড়া কোনও প্রত্যক্ষ মাধ্যম নেই। গণিতের বই-পুস্তক প্রকাশ লিপি আবিষ্কার সাপেক্ষ। হরপ্পা মহেঞ্জেদরো-তে লিপি ছিল, কিন্তু তা আজও পাঠোদ্বার করা সম্ভব হয় নি।
হরপ্পা-মহেঞ্জেদারো নগর পরিকল্পনা, মাটির পাত্রগুলি, অলঙ্কার, শীলমোহর প্রভৃতির বিচিত্র নকশা কি পরিমিতি বিদ্যা বা জ্যামিতি জ্ঞানের পরিচায়ক নয়? এখানে নানা ওজনের অজস্র নমুনা পাওয়া গেছে। বাটখারাগুলির অধিকাংশ ঘন বা কিউব আকৃতির নিখুঁত গঠন। ছোট থেকে বড় ওজনগুলির পারস্পরিক অনুপাত যথাক্রমে ১, ২, ৮/৩, ৪, ৮, ১৬, ৩২, ৬৪, ১৬০, ২০০, ৩২০, ৬৪০, ১৬০০, ৩২০০, ৬৪০০, ৮০০০ এবং ১২৮০০ । এর মধ্যে ১৬ সংখ্যাটি দ্বারা সূচিত ওজনটি ছিল সবচেয়ে বড় একক। সেযুগে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্তরে পৌঁছেছিল তাতে লিপি ও পাটিগণিতে দক্ষতা আয়ত্ত করা অবশ্যম্ভাবী ছিল।
কৃতজ্ঞতা – ক) প্রাচীন ভারতের গণিত চিন্তা - অধ্যাপক রমাতোষ সরকার
খ) কল্যান দাস ব্যক্তিগত লাইব্রেরি
Comments :0