ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান প্রায় এক বছর অতিক্রম করতে চলল। প্রথম দিকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাশাপাশি পদাতিক সেনা অভিযান ছিল। ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল রুশ সেনাদের আংশিক বা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পরে ধাপে ধাপে রুশ সেনা বেশিরভাগ অংশ থেকে সরে এসে পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনে ঘাঁটি গাড়ে। রুশ সেনারা যেসব জায়গা থেকে সরে আসে সেখানে ইউক্রেনের বাহিনী পুনর্দখল করে। বর্তমানে পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেন রুশ বাহিনীর পূর্ণ দখলে।
এই অংশের অধিবাসীরা গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। রাশিয়াও সেই প্রস্তাবে সায় দিয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনকে রাশিয়ার সার্বভৌম অংশ বলে ঘোষণা। এই মুহূর্তে ইউক্রেন তাদের হারানো জমি ফেরাবার জন্য যুদ্ধ চালাচ্ছে আর রাশিয়া অবশিষ্ট ইউক্রেনে মাঝে মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে।
রুশ হামলায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে মিটমাটে প্রস্তুত নয়। তারা অসম যুদ্ধে রাশিয়ার মোকাবিলা করে জয়ের স্বপ্ন দেখছে। তার জেরে সবচেয়ে দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষকে। পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতে লেগেছে জোরালো ধাক্কা। বিশ্ব বাজারে বৃহৎ গম রপ্তানিকারীদের অন্যতম রাশিয়া ও ইউক্রেন। যুদ্ধের ফলে গম রপ্তানি বিপর্যস্ত হওয়ায় খাদ্যের দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। তেমনি বাড়ে সারের দামও। অন্যদিকে রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস সরবরাহও বাধাপ্রাপ্ত হয়। তার ফলে বেড়ে যায় অপরিশোধিত জ্বালানির দাম। তেল আমদানির উপর দেশগুলির সমস্যা তীব্র আকার নেয়।
রাশিয়া ইউক্রেনে সেনা অভিযান শুরু করেছে মানে এই নয় যে এটা নিছকই দু’টি দেশের মধ্যেকার দ্বিপাক্ষিক বিরোধের পরিণতি। বাস্তবে রাশিয়া এরকম নিরুপায় হয়েই সেনা অভিযানে বাধ্য হয়েছে। তেমনি ইউক্রেনও একা একা রাশিয়ার মতো বৃহৎ সমর শক্তির মোকাবিলা করছে না। ইউক্রেন এখানে উপলক্ষ মাত্র। মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমী দুনিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে দাবার বোড়ের মতো ব্যবহার করছে। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ তাদের নিজেদের স্বার্থে রাশিয়াকে কোণঠাসা করে সমগ্র পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাবাধীন দেশগুলিতে তাদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে। রাশিয়া সেটা কোনও অবস্থাতেই রাজি নয়।
ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত প্রভাব থেকে ইউরোপকে বাঁচিয়ে মার্কিন প্রভাবে রাখার জন্য মার্কিন উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ন্যাটো সামরিক জোট। সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর ন্যাটোর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও তাকে গুটিয়ে না ফেলে সম্প্রসারণের কাজে নামে আমেরিকা। প্রথমে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এবং পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে ওঠা দেশগুলিকে ন্যাটোর সদস্য বানিয়ে সকলকে রাশিয়ার দিকে বন্দুক তাক করার ব্যবস্থা করে। এইভাবে পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রাশিয়া তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে গুরুতর উদ্বেগের কারণ বলে চিহ্নিত করে। বার বার দাবি জানায় এইভাবে সম্প্রসারণ করে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলা বন্ধ করার। রাশিয়ার প্রতিবেশী ইউক্রেন যাতে ন্যাটো সদস্য না হয় তার জোরালো দাবি জানায় রাশিয়া। কিন্তু আমেরিকার নেতৃত্বে ইউক্রেনকে প্ররোচিত করে ন্যাটো সদস্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি। ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য হওয়া মানে রাশিয়ার সীমানায় ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন। এই অবস্থায় রাশিয়া নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি আটকাতে সামরিক অভিযান শুরু করে।
স্বাভাবিকভাবেই এই যু্দ্ধ আসলে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য না করলে কোনও সমস্যা থাকে না। তেমনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের অসম যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতা না হলেও মূলত আমেরিকার অর্থ ও সামরিক সাহায্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে ইউক্রেনকে সামনে রেখে। আমেরিকা যদি চায় এখনই যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মার্কিন উসকানি ও প্ররোচনাতেই ইউক্রেন চলছে। পশ্চিমী হাত সরে গেলেই আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা সহজ হয়ে যাবে।
Comments :0