Editorial Ganashakti Budget

ইহা নাকি বাজেট

সম্পাদকীয় বিভাগ

Budget Editorial Ganashakti


বাজেট মানে যে নিছক আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, বরং রাজ্যের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থায় সূচারু বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং সেই মতো পরিকল্পনা করে স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ, গত এক দশকেরও বেশি সময় সরকার চালি‌য়েও সেই বোধবুদ্ধি আয়ত্ত করতে পারেনি তৃণমূল সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর ঘুম থেকে উঠে কিছু মনে হলো আর সেটাই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল বাজেটে। বিধানসভায় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা চলাকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে আসা একটি চিরকূট পড়ে অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন কর্মচারীদের ৩ শতাংশ ডিএ দেওয়া হবে মার্চ মাস থেকে। বাজেট বইয়ে ডিএ’র কোনও উল্লেখ নেই, তার জন্য বরাদ্দও নেই। তার মানে বাজেট ভাষণ শুরুর আগে পর্যন্ত সরকারের কোনও স্তরেই ডিএ ‍‌নিয়ে কোনও আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। বাজেট ভাষণ চলাকালীন হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রীর মনে হয়েছে ডিএ দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে চিরকুটে লিখে পাঠালেন ভাষণরত অর্থমন্ত্রীর কাছে। অর্থমন্ত্রী চিরকুট  দেখে ডিএ ঘোষণা করে দিলেন। রাজ্যে কীভাবে সরকার চলছে, কীভাবে বাজেট হয় এটাই বোধহয় তার সেরা নমুনা।

বাজেটে দাবি করা হয়েছে মোট বরাদ্দের ৬৫ শতাংশই নাকি সামাজিক খাতে। কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু মুশকিল হলো এই সরকার সামাজিক খাত বলতে শুধু বোঝে নগদ অর্থ বিলি। নানা রকমের শ্রী বিশ্রী প্রকল্প। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে নগদ অনুদানমূলক প্রকল্প অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সেগুলি সব চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো হতে পারে না। সামাজিক খাতের সব বরাদ্দই যদি শুধু নগদ অনুদানে ব্যয় হয় তাহলে উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে যাবে, সম্পদ সৃষ্টি হবে না, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে না। একটা অনুদানজীবী অলস সমাজ তৈরি হবে। অর্থনীতির জ্ঞান সেই শিক্ষা দেয় না। বরং এই বোধ তৈরি করে দেয় সামাজিক খাতের অর্থ এমনভাবে ব্যয় করতে হবে যাতে আশু প্রয়োজনও মিটবে, ভবিষ্যতের সম্পদও তৈরি হবে। তৃণমূল জমানায় অর্থনীতির মৌলিক জ্ঞানকে অস্বীকার করে মানুষের আনুগত্য (ভোট) কেনার জন্য নগদ টাকা বিলিকেই আশ্রয় করা হয়েছে। ফলে রাজ্যে স্থায়ী সম্পদ তৈরির রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মসংস্থান তৈরির জন্য বহুমুখী প্রকল্পের ভাবনা পরিত্যক্ত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের অর্থনীতির অবনতির ধারার গতি বাড়ছে। এইভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়বে।

অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন তাদের আয়ের উৎস ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। এটা যে তাদেরই ধারাবাহিক অজ্ঞতা ও খামখেয়ালিপনার ফলে সেটা সম্ভবত বুঝতে চাননি। যে রাজ্যে শিল্পায়নের পাকাপাকি ছুটি হয়ে গেছে অনেক আগে, যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থাটাই জালিয়াতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, দুর্নীতিই যেখানে স্বাভাবিক নিয়ম, যেখানে কর্মহীনতা যুব সমাজের ভবিতব্য সেখানে আয়ের উৎস যে হ্রাস পাবে সেটা বুঝতে অর্থমন্ত্রী হবার প্রয়োজন হয় না। অবশ্য এই সরকার এটা ভালো বোঝে মানুষকে যত কর্মহীন-রোজগারহীন করে রাখা যাবে ততই তারা সরকারি অনুদানের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়বে। ভোটে জেতার সেটাই সহজ উপায়। একটা জাতি, একটা সমাজকে ধ্বংস করে দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা যাদের অগ্রাধিকার তাদের মাথায় অর্থনৈতিক বোধবুদ্ধির জায়গা হতে পারে না। তাই রাজ্যটাকে আকণ্ঠ ঋণে ডুবিয়ে ভোট কেনার টাকা জোগাড় করতে তারা দু’বার ভাবে না। গত ১১ বছরে ঋণের বোঝা বাড়ানো হয়েছে সাড়ে তিনগুণ। একইভাবে কর্মহীন বেকার যুব সমাজকে মদের নেশায় ডুবিয়ে রাখতে সবচেয়ে জোর দেওয়া হয়েছে মদের ব্যবস্থা প্রসারে। একাজে সর্বাধিক সাফল্য এসেছে। ১১ বছর মদ থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণ। বর্তমান সরকার যা আয় করে তার একটা চতুর্থাংশই আসে ঋণ থেকে। তেমনি বছর বছর যত ঋণ শোধ করতে হয় তার থেকে বেশি নিতে হয় নতুন ঋণ। কর বসানো হয়নি ঠিকই কিন্তু আয় বাড়বে বিদ্যুৎ থেকে, তেল-গ্যাস থেকে। তাহলে কি মাঝ পথে বাড়তে চলেছে বিদ্যুতের মাশুল এবং তেল-গ্যাসের উপর ভ্যাট?

Comments :0

Login to leave a comment