CBI R G KAR

তথ্যপ্রমাণ লোপে কাজ করেছে পরিণত মাথা, ধারণা সিবিআই’র

রাজ্য

 খাবার এসেছে অনলাইন। খাবার খাওয়া হয়েছে, তাহলে সেই প্যাকেট কোথায়? কীসে খাওয়া হয়েছে? কাগজের প্লেট হোক বা থালা, তা কোথায়? 
সেই রাতে সেই সময় সেমিনার রুমে উপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রমাণের ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হদিশ নেই। পরিকল্পিতভাবে তা সরিয়ে বা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে কি?
যেভাবে একটার পর একটা তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট, পরিণত মস্তিষ্কই রয়েছে এর পিছনে। টানা ছয়দিন ধরে তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ সহ পঁচিশ জনের বেশি ব্যক্তিকে জেরা এমনই মনে করছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। না হলে এমন নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরে, ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে থাকা অবস্থাতেই এমন কিছু ‘তৎপরতা’ দেখতে পাওয়া যেত না! সেই তৎপরতার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তথ্যপ্রমাণকে নষ্ট করা বা বিকৃত করা। সিবিআই জানতে চাইছে কোথায় গেল সেই খাবারের প্যাকেট বা প্লেট? তার কোনও চিহ্নই ছিল না সেমিনার রুমে। 
এমনকি পুলিশের ‘সিজার লিস্ট’ও তা ছিল না। সাধারণ এমন অপরাধের ঘটনায় নমুনা পরীক্ষার জন্য এসব সংগ্রহ করাই পুলিশের তদন্তকারী আধিকারিকদের রুটিন কাজ। কার নির্দেশে এক্ষেত্রে হলো না? ইতিমধ্যে সেদিন রাতে আর জি করের ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের চার তলার সেমিনার রুমে নিহত ওই তরুণী চিকিৎসকের সঙ্গে যে চারজন একসঙ্গে খাবার খেয়েছিলেন বলে পুলিশি তদন্তে দাবি করা হয়েছিল তাঁদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন সিবিআই আধিকারিকরা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে খাবারে প্যাকেটের হদিশ মেলেনি। যা মিললে তদন্তের সুবিধা হতো বলেই মনে করছে সিবিআই। মনে করা হচ্ছে, পুলিশের মতো পেশাদার বাহিনী ছাড়া সাধারণভাবে এমন বুদ্ধি বা পরিকল্পনা অন্য কোনও অংশের থাকতে পারে? জানতে চাইছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও।
সিবিআই’র একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, সেদিন সকাল দশটা দশ মিনিটে চারতলার সেমিনার রুমে পৌঁছেছিল পুলিশ। তারপর সেখান থেকে ক্ষতবিক্ষত তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার করা হয়। পৌনে একটা নাগাদ ময়নাতদন্তের জন্য তা পাঠানো হয় আর জি করেই। সাধারণভাবে অপরাধের ঘটনায়, দেহ উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গেই গোটা এলাকা ঘিরে ফেলা হয়। এক্ষেত্রে তা হয়নি। দেহ যেখানে পড়েছিল তার লাগোয়া জায়গা পুলিশ ঘিরে দেয়। কলকাতা পুলিশের মতো এত ‘দক্ষ’ বাহিনীর এমন ভুলের মানে কী? কেন তা ঘিরে দেওয়া হয়নি? সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, পুলিশকে ওই এলাকা ঘিরে না রাখার ‘নির্দেশ’ দিয়েছিলেন তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ!
উঠছে প্রশ্ন, পুলিশকে এমন নির্দেশ তিনি দিলেন আর পুলিশও তা মেনে নিলো কীভাবে? কোনও বড় মাথার হস্তক্ষেপ ছাড়া তা সম্ভব? তথ্যপ্রমাণ নষ্ট বা বিকৃতিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেই কি সরাসরি যুক্ত পুলিশ? সন্দীপ ঘোষের পেটোয়া কয়েকজন দেহ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন। তারপর অনেকে আসেন। সেখানে বৈঠকও হয়। 
একই সঙ্গে সিবিআই’র তরফে পানিহাটি শ্মশানে যে তৎপরতায় শেষকৃত্য করা হয়েছিল, তাতে পুলিশের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এভাবে তড়িঘড়ি দেহ পোড়ানো হয়েছিল, দ্বিতীয় বারের ময়নাতদন্তের কোনও সুযোগ না রেখে, যেভাবে বাবা-মাকে কার্যত নজরবন্দি রেখে যুদ্ধকালীন তৎপতায় পানিহাটি শ্মশানে শেষকৃত্য হয় তা নিয়ে সামনে এসেছে একাধিক প্রশ্ন। এমনকি সেদিন পুলিশ যখন মৃতদেহ নিয়ে নির্যাতিতার বাড়ি পৌঁছায় সেই সময় পরিবারের কেউ ছিলেন না। তার কিছু পরেই দ্রুত বাড়িতে আসেন মৃতার বাবা-মা। ততক্ষণে গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পুলিশ-তৃণমূলী যৌথ বাহিনী। ভোম্বলা মোড় থেকে নাটগড় পোস্ট অফিস পর্যন্ত গোটা রাস্তা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। এলাকাবাসীর সূত্রেই জানা গিয়েছে, বাড়ির ভিতরে সেই সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে রীতিমতো বাক্‌বিতণ্ডা হয় পুলিশের। যেভাবে চাপ দিয়ে দ্রুত দেহ পোড়াতে চাইছিল পুলিশ তাতে তাঁরা আপত্তিও জানান। কিন্তু পুলিশ ও তৃণমূল নেতারা চাপ দিয়ে দ্রুত রীতিমতো কনভয় করে দেহ নিয়ে চলে যায়। এমনকি সেই সময় পানিহাটি শ্মশানে আরও দুটি দেহ ছিল। সেই পরিবারের সদস্যদেরও সরিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর গোটা শ্মশান চত্বর ঘিরে রাখে তৃণমূলী বাহিনী। বাড়ি থেকে শ্মশান পর্যন্ত এই গোটা পর্বে ছিলেন বিধায়ক পুত্র ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তীর্থঙ্কর ঘোষ, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলী কাউন্সিলর সম্রাট চক্রবর্তী, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সোমনাথ দে ও স্থানীয় তৃণমূল নেতা সঞ্জীব মুখার্জি। প্রত্যেকেই মূলত বিধায়ক নির্মল ঘোষের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এমনকি এখন শ্মশান ঘাটের কর্মীরাও সংবাদমাধ্যমের সামনো স্বীকার করেছেন, যত তাড়িতাড়ি এলাকা ফাঁকা করা যায়, পুলিশ সেটাই চেষ্টা করছিল। পুলিশ আগেই জানিয়েছিল যে একটা দেহ আসছে। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করতে হবে।’ এমনকি পানিহাটি পৌরসভার তরফে যে শবদাহের ঘাট সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে তাতে নিহত তরুণী চিকিৎসকের বাবা-মা বা পরিবারের কারও স্বাক্ষর নেই, রয়েছে তৃণমূল নেতা সঞ্জীব মুখার্জির সই। এই যুদ্ধকালীন তৎপরতা কি দ্বিতীয় বারের ময়নাতদন্তের কোনও সুযোগ যাতে না থাকে তার জন্য? সিবিআই সূত্রের দাবি, এরকম সংবেদনশীল ঘটনায় দ্বিতীয়বারের ময়নাতদন্ত প্রয়োজন ছিল।
 

Comments :0

Login to leave a comment