রামশংকর চক্রবর্তী: তমলুক
২৫ অক্টোবর- প্রশাসনের দেখা পাওয়া যায়নি। অথচ নদীবাঁধ পাহারা দিচ্ছে রেড ভলান্টিয়ার্স। ঘুর্ণিঝড় ‘দানা’র ঘোষণার সাথে সাথেই পূর্ব মেদিনীপুরের রেড ভলান্টিয়ার্সরা তৈরি ছিল। বিশেষত নদী তীরবর্তী ও উপকূল এলাকায় গ্রাম পঞ্চায়েত ভিত্তিক ছোট ছোট টিম করে নদীবাঁধ পাহারা দিয়েছে রেড ভলান্টিয়ার্স বাহিনী।
পাঁশকুড়া, খেজুরি, জুনপুট, বাঁকিপুট, দীঘা, রামনগর, পটাশপুর, ভগবানপুর, মহিষাদল, কোলাঘাট, নন্দকুমার, হলদিয়া, তমলুক, নন্দীগ্রাম ব্লকগুলির উপকূল ও নদী তীরবর্তী এলাকাগুলিতে বাড়তি নজর ছিলই। কিন্তু প্রশাসনিক ভুমিকা কী ছিল? শুধুমাত্র দীঘা, মন্দারমণি, তাজপুর, শঙ্করপুরের মতো সমুদ্র উপকূল ছাড়া বাকি এলাকাগুলিতে দেখা পাওয়া যায়নি প্রশাসনের।
ঘুর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে দিনভর অতিভারী বৃষ্টিতে পূর্ব মেদিনীপুর পুরোপুরি বিপর্যস্ত। জেলার সর্বত্র জনজীবন স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে লাগাতার বৃষ্টির ফলে জেলার বিভিন্ন ব্লক জলমগ্ন হয়েছে। উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে ঝড়ের সরাসরি প্রভাব পড়েছে। তবে জেলার বাকি অংশে ঘূর্ণিঝড়ে তেমন ক্ষতি না হলেও লাগাতার বৃষ্টির ফলে সবজি, ধান, পান সহ বিভিন্ন ফসল জলের তলায়। জেলার ব্লকগুলির মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খেজুরি। একাধিক মাটির বাড়ি ধসে পড়েছে। ফ্লাড সেন্টারগুলি বেহাল থাকার ফলে বহু মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। শুক্রবারও রাতভর বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে পূর্ব মেদিনীপুরের আরও বহু এলাকা জলমগ্ন হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। দানা'র প্রভাবের ফলে বিদ্যুৎহীন হয়েছে একাধিক ব্লক।
লাগাতার বৃষ্টিতে খেজুরির সমুদ্র উপকূবর্তী এলাকাগুলির নিচকসবা, পাঁচুড়িয়া, মতিলালচক, কাদিরাবাঁধ, বারাতলা গ্রাম পঞ্চায়েতের পিরিজপুর, খেজুরি বটতলা, সাতশিমলী ও কলাগাছিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ঘোলাবাড় গ্রামগুলিতে শতাধিক মাটির ঘর ভেঙে পড়েছে। কয়েকশ গাছ ভেঙে পড়েছে। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাগুলি জলমগ্ন। মৎস্যজীবীদের গ্রামগুলির অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। স্থানীয় পাকা বাড়ি ও স্কুলগুলিতে রেড ভলান্টিয়ার্সরা আশ্রয়হীন মানুষদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বঙ্গোপসাগরের খেজুরির প্রান্তে সমুদ্রবাঁধ না থাকায় যে কোনও ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে বারে বারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় খেজুরি। প্রতিবছর প্রায় ৭ হাজার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন। যাদের অধিকাংশই গরিব, নিম্নবিত্ত ও মৎস্যজীবী। কেন সমুদ্রবাঁধের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে না সরকার, আবারও এই প্রশ্ন উঠেছে জোরালোভাবে। এই খেজুরিতেই আমফান ও ইয়াসে প্রায় ৫ হাজার মাটির বাড়ি ও ছোট পাকা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত যারা আবাস যোজনার ঘর পাওয়ার যোগ্য তাদের ঘরের অর্থ দেওয়া হয়নি। বহু মানুষ এখনও আমফানের ক্ষতিপূরণটুকুও পায়নি। খেজুরির উপকূল এলাকা নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই প্রশাসনের। ফলে প্রত্যেক বছর কয়েক হাজার মানুষকে আশ্রয়হীন হতে হয়। কাঁচা বাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর নিজেরাই কোনোক্রমে ত্রিপল, খড় দিয়ে সারিয়ে বসবাস করেন মৎস্যজীবীরা।
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সদর তমলুক শহরের বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। পৌরসভার ৫, ৭, ৮, ১৮, ১৯, নম্বর ওয়ার্ড জলমগ্ন। বেশ কিছু এলাকা রূপনারায়ণের জলে প্লাবিত হয়েছে। তমলুক হাসপাতালের সামনেও হাঁটুসমান জল জমে যায়। এদিকে, সকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে ময়নার বিভিন্ন এলাকায় হাঁটুসমান জল জমে যায়। হলদিয়া পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে যাতায়াতের রাস্তা জলের তলায়। সিটি সেন্টার থেকে পৌরসভা যাওয়ার রাস্তায় হাঁটু সমান জল। সিটি সেন্টার থেকে মঞ্জুশ্রী যাওয়ার রাস্তা যেন মরণফাঁদ। অন্যদিকে, বন্যাবিধ্বস্ত পাঁশকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় আবারও জল জমতে শুরু করেছে। বাড়ছে কাঁসাইয়ের জলস্তর। গোবিন্দনগর, মানুর প্রভৃতি এলাকায় যেখানে মাত্র ১ মাস আগেই নদীবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছিল পাঁশকুড়া, সেই এলাকায় রেড ভলান্টিয়ার্সরা পাহারায় রয়েছে।
পাশাপাশি নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষজন আতঙ্কিত হচ্ছে। বিশেষত মহিষাদলের দনিপুর, অমৃতবেড়িয়া নন্দকুমার ব্লকের ভোলসরা, ঠেকুয়া, ভগবানপুরের কেলেঘাই তীরবর্তী এলাকা। গুরুত্বপূর্ণ নিকাশি খালগুলির সংস্কার না হওয়ায় জমা জল নিষ্কাশন হচ্ছে না। শহীদ মাতঙ্গীনি ব্লকের সোয়াদিঘি, বাপুর, চণ্ডীপুর ব্লকের মগরাজপুর খাল সংস্কার হয়নি। জেলার বৃহৎ খাল এইচটিসি ক্যানেলও সংস্কার করা হয়নি। ফলে টানা বৃষ্টিতে জলমগ্ন এলাকাগুলি থেকে জল বের হচ্ছে না।
পাঁশকুড়ায় বন্যার ফলে ধান, সবজি, ফুল চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আগেই। বন্যার মাত্র একমাস পর ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন কৃষি। এইসময় ধান পাকতে শুরু করে। হাজার হাজার হেক্টর ধান জমি জলের তলায়। একই অবস্থা সবজি, পান, বাদাম চাষেও। চাষের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে কৃষকদের। পাশাপাশি পুকুর, মাছের ভেড়িগুলির জল উপচে ভেসে গেছে। মাছ চাষেরও ক্ষতির হয়েছে ব্যাপক। বন্যার জল নামার পর নতুন করে ফুল চাষের জমি প্রস্তুত করে ফুল চারা বসানোর কাজ চলছিল পাঁশকুড়ার বিভিন্ন এলাকায়। সেই জমিগুলিতে আবারও জল জমে যাওয়ায় নতুন করে ক্ষতির সম্মুখীন কৃষকরা।
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজী বলেন, “এখনও পর্যন্ত পাওয়া প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৬০০ মাটির বাড়ি ভেঙেছে। ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিদ্যুতের খুঁটি, তার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ১৭ হাজার হেক্টর আমন ধানের জমি, ১৫০০ হেক্টর সবজি চাষের জমি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। জেলার কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রশাসনিক নজরদারি রয়েছে।”
DANA PANSKURA
দানার দাপটে ফের বন্যার ভ্রুকুটি পাঁশকুড়া, খেজুরিতে
×
Comments :0