ওয়াশিংটন শহরে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) ও ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক গ্রুপের বার্ষিক সম্মেলন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো (১০ -১৬ অক্টোবর)। এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন পৃথিবীর ১৯০টি দেশের অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যা ঙ্কের শীর্ষকর্তা, বিভিন্ন আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার প্রতিনিধি। অন্যান্য বছরে এই সম্মেলনগুলিতে প্রথামাফিক যে সব বিষয়ে আলোচনা হয়ে থাকে এবারে সেই সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি সবার বক্তব্যের মধ্যেই গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কার সঙ্গে আলোচিত হয়েছে তা হলো বিশ্বব্যাপী ঘনায়মান অর্থনৈতিক সঙ্কট। আইএমএফ’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর ক্রিস্টালিনা জর্জিলেভা সম্মেলন শেষে বিশ্বের সবদেশের অর্থব্যবস্থার অভিভাবকদের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, ‘সিট বেল্ট বাঁধুন এবং সঙ্কট নিরসনে মন দিন’। যে সঙ্কট নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত দুর্ভাবনা, তা প্রকট হতে শুরু করেছিল এই সম্মেলন শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই। বলা যেতে পারে, ২০২০ সালে পৃথিবী জুড়ে করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব থেকেই।
করোনা ভাইরাসের আক্রমণ যখন দেশে দেশে শুরু হলো তখন তা ছিল এক অভূতপূর্ব, অজানা এবং ভয়াবহ সংক্রমণ। কিন্ত তার প্রতিরোধ করতে সব দেশেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার এবং লকডাউন জারি করার যে নিদান সাব্যস্ত হলো তা হয়ে উঠল আরও এক মহা বিপর্যয়ের কারণ। মানুষের মধ্যে যাতে সংক্রমণ না ছড়ায় তার জন্য প্রয়োজন ছিল কলকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য, অন্তর্দেশীয় যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক চলাচল সব কিছুই বন্ধ রাখা। ২০২০ থেকে কমবেশি দু’বছর ধরে বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ অথবা স্বল্প মেয়াদের লকডাউন ঘোষণা করা হলো। ষার ফলে অচল এবং অবরুদ্ধ হয়ে থাকল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি। এর অনিবার্য ফল হলো বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কোচন, বিশেষজ্ঞরা বলেন, “ইকনমিক স্লো ডাউন’। অর্থাৎ আয়, কর্মসংস্থান, নিয়োগ, বিনিয়োগ, উৎপাদন সবকিছুই হ্রাস পেতে থাকল। ‘প্যান্ডেমিক’-এর সহযাত্রী হলো ‘স্লো ডাউন’। ভারতে অবশ্য আগের বছরেই অর্থাৎ ২০১৯-২০ থেকেই অর্থনৈতিক সঙ্কোচনের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। জিডিপি বৃদ্ধির গতি সে বছরেই কমে গিয়েছিল। করোনার হামলা এবং দীর্ঘ ৬ মাসের লকডাউনের ফলে ২০২০-২১ সালের প্রথম তিন মাসে জিডিপ’র ‘গ্রোথ’ তো হলোই না, বরং ‘নেগেটিভ গ্রোথ’ হলো (-) ২৪ শতাংশ। বছর শেষে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি হলো (-) ৭ শতাংশ। পৃথিবীর সব দেশেই উৎপাদন, কাজ, রোজগার অল্পবিস্তর একইভাবে নিম্নগতি হয়েছে। আই এম এফ-এর হিসাবে ২০২০ সালেই বিশ্বের মোট উৎপাদন ২০১৯-এর তুলনায় কমে গিয়েছিল ৩.৫ শতাংশ। যার মানে হলো এক বছরেই সারা বিশ্বের মিলিত উৎপাদন কমে গেল ২ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ইতালির জাতীয় উৎপাদনের প্রায় সমান!
মহামারী ও মহামারী জনিত ‘স্লো ডাউন’ কাটিয়ে উঠতে সাধারণত কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। যথা, দেশের মানুষের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেওয়া অথবা সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প শুরু করা অথবা গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্যশস্য ও ভোগ্যসামগ্রীর সরবরাহ বৃদ্ধি করা। উদ্দেশ্য হলো যাতে কাজ-হারানো সঙ্কোচন-ক্লিষ্ট মানুষদের দেশের উৎপাদিত সামগ্রী কেনার ক্ষমতা কিছুটা বজায় থাকে। পরিভাষায় এই পদক্ষেপগুলিকে বলা হয় ‘ফিসক্যাল স্টিমূলাস’ যার ব্যয়ভার সরকারের কোষাগার থেকেই মেটাতে হয়। আমেরিকাতেই ২০-২১ সালে সরকার থেকে প্রতিটি করদাতাকে ‘স্টিমূলাস চেক’ এর মাধ্যমে ৩৭০০ ডলার করে সরাসরি দেওয়া হয়েছিল। ভারত সরকার এভাবে নাগরিকদের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেয়নি। যখন জানা গেল কয়েক লক্ষ ‘মাইগ্রান্ট লেবার’ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আটকে আছে, কাজ হারিয়েছে লকডাউনের ফলে তখন তাদের ঘরে ফেরানোর একটি হৃদয়বিদারক অমানবিক ব্যবস্থা করে গ্রামীণ রোজগার যোজনায় বরাদ্দ অর্থের মাধ্যমে সমস্যার কিছুটা সুরাহা করা হয়েছিল। আইএমএফ’র একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যাতে আছে কোভিড-দুর্যোগ থেকে পৃথিবীর মানুষকে সুরাহা দিতে ১৯০টি দেশ কতটা উদ্যোগ নিয়েছিল। যে ‘ফিসক্যাল স্টিমূলাস’-এর কথা বলা হলো, সেগুলোর জন্য জিডিপি’র কতটা অংশ সরকার ব্যয় করেছে তা এই উদ্যোগের নির্ভরযোগ্য পরিমাপ হতে পারে। আইএমএফ’র রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, উন্নত দেশগুলি যেখানে জিডিপি’র শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ পর্যন্ত এই খাতে বরাদ্দ করেছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলি সেখানে ব্যয় করেছে শতকরা ১ থেকে ৪ ভাগ। জিডিপি’র নিরিখে ভারত নিম্ন আয়ের দেশ নয় মোটেই, বরং জিডিপি’র ক্রমে সম্প্রতি পঞ্চম স্থান অধিকার করে দেশের শাসক দলকে আত্মশ্লাঘায় সোচ্চার হতে দেখা যায়। তবুও ভারত সরকার মাত্র ৩.৫ শতাংশ কোভিড বিপর্যস্ত মানুষের জন্য ব্যয় করেছে। অভূতপূর্ব মহামারী যখন পৃথিবীর ৬০ কোটিরও বেশি মানুষকে আক্রমণ করেছে এবং ৬৫ লক্ষের প্রাণ হরণ করেছে তখন মানুষের স্বার্থে ও কল্যাণে ত্রাণ, সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসার কাজে এই নিরুত্তাপ শীতলতা বিষয়ে ঐতিহাসিকেরা গবেষণা করে দেখবেন নিশ্চয়ই। কিন্ত মহামারীর প্রকোপ স্তিমিত হয়ে এলেও অর্থনীতির ক্ষতচিহ্ণগুলি শুকিয়ে যায়নি। বরং নতুন ব্যাধি এসে হাজির হয়েছে। তা হলো মূল্যবৃদ্ধি। আমরা যারা তৃতীয় বিশ্বের একদা উন্নয়নশীল, অধুনা পরিচিত ‘ইমারজিং ইকনমি’-র বাসিন্দা তাদের জীবনে মুদ্রাস্ফীতি কোনও অপরিচিত সমস্যা নয়। মারী ও মড়কের মতো মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গেও আমরা ঘর করছি বহুকাল। কিন্ত আমেরিকাবাসীর কাছে তা নয়। গত কুড়ি বছর ধরে সে দেশে যা মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে তা অতি মূদু, অকিঞ্চিৎকর– মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যেই। তার সঙ্গে সুদের হার ছিল শূন্যের কাছাকাছি বা তার একটূ উপরে। মহামারীর মেঘ কেটে যেতেই আমেরিকায় মূল্যবৃদ্ধির দানব এসে দেখা দিল। আমেরিকার শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডেরাল রিজার্ভ এই আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত সঙ্কট মোকাবিলার জন্য যে পদক্ষেপ নিল তাও অর্থশাস্ত্র নির্দেশিত চিরাচরিত ‘মনিটরি স্টিমূলাস’, অর্থাৎ সুদের হার ক্রমশ বাড়িয়ে যাওয়া। গত মার্চ থেকে আমেরিকায় সুদের হার বাড়ানো হয়েছে ইতিমধ্যেই পাঁচ বার। তবু মুদ্রাস্ফীতির প্রকোপ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কোভিড-উত্তর পর্বে সব দেশেই মূল্যবৃদ্ধি তীব্র আকার নিয়েছে। সব দেশই তার হাত থেকে রক্ষা পেতে মহাজন যে পথে গেছে সেই পথই ধরল। আমেরিকার ফেডেরাল ব্যাঙ্ক চাইছে মূল্যবৃদ্ধির হার দুই শতাংশে নামিয়ে আনতে। ভারতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্দেশ্য মুদ্রাস্ফীতির হার যেন ৬ শতাংশের উপরে না যায়। গ্রেট ব্রিটেন তো এখন বিপর্যস্ত দেশ, অনিশ্চয়তায় অস্থির। ইওরোপের দেশগুলিতে তীব্র জ্বালানি সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এই দেশগুলির জ্বালানির প্রধান অবলম্বন, গ্যাস ও পেট্রোলের দাম ঊর্ধ্বগামী। এমনও প্রস্তাব আসছে ইওরোপের নাগরিকদের জ্বালানি কেনার জন্য সরাসরি ‘স্টিমূলাস চেক’ দেওয়া হোক। নাহলে আসন্ন শীতে বহু লোকের প্রাণহানি হতে পারে।
তাহলে কি এই পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে? মহামারী, আর্থিক সঙ্কোচন, মন্দা, মূল্যস্ফীতি— যে সমস্যাই আসুক, শুধুমাত্র ‘মনিটরি’ অথবা ‘ফিসক্যাল স্টিমূলাস’ তূণ থেকে এই দুটি অস্ত্র বার করলেই কী এই যুদ্ধ জয় হবে? মনে হয় আমাদের মনোযোগ ও দৃষ্টি অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে ফেরাতে হবে। রাষ্ট্রের কোনও আলোকপ্রাপ্ত কর্ণধার বা কোনও প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদ শীর্ষ ব্যাঙ্কের কর্তার একক বা মিলিত প্রয়াসেও হতে পারে না। এই বিশ্বের ঐশ্বর্য, সম্পদ ও মণীষা বিপুল সন্দেহ নেই। কিন্ত উৎকট ও ভয়ঙ্কর বৈষম্য পাশাপাশি দৃশ্যমান এবং ক্রমবর্ধমান। সাম্প্রতিক মহামারী ও তার দ্রুত প্রতিরোধ ও নিরসনে যেমন মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, কর্মকুশলতার বিস্ময়কর প্রকাশ ঘটেছে, তেমনই অসম সমাজের, বৈষম্য-লাঞ্ছিত পৃথিবীর ছবিটাও বারবার সামনে এসেছে। এই বৈষম্যের কারণেই এমনও দেশ অনেক আছে যেখানে শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ করোনা প্রতিষেধক পাননি। এই বৈষম্যই গত দু’বছরে বহু দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতেই সাড়ে তিন কোটি মধ্যবিত্ত আয় ও কাজ হারিয়ে দারিদ্রসীমার প্রান্তে দাঁড়িয়ে। অসাম্যের প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গিয়ে, বৈষম্যের নিরসন না করে অর্থনীতির টেক্সট বইয়ের পাতায় সমাধান খুঁজলে হবে না ।
Comments :0