Tea Workers

মেলেনি ন্যূনতম মজুরি, দাবি ভোলাতে তৃণমূল সরকার ধরিয়েছে লটারির নেশা

রাজ্য

ভোট প্রচারে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে অনড় চা বাগান। নকশালবাড়ির মেরিভিউ চা বাগানে ছবি তুলেছেন শ্যামল মজুমদার।

পীয়ূষ ব্যানার্জি: শিলিগুড়ি 
কোটি টাকার সঙ্গে যোগ সাত-সাতটা শূন্যের। দিনভর কাজ করে বাগান শ্রমিকের মজুরিতে ফি দিন যোগ হয় শুধু একটি শূন্য!
সাত শূন্য যোগে তৃণমূল শুধু লটারি কোম্পানির থেকে আয় করেছে ৫৪২ কোটি টাকা। ৯ বছর ধরে অপেক্ষার পর বাগান শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে হয়েছে মাত্র ২৫০ টাকা। দৈনিক মজুরিতে শূন্য যোগ এখানে একটিমাত্র বারের জন্য। ন্যূনতম মজুরি এখানে শূন্য। ১৬০০ কোটি টাকা নির্বাচনী তহবিলে আয় করে চা শ্রমিকদের ভাতা বেড়েছিল মাত্র ১৮ টাকা। বাগান শ্রমিকরা বলছেন, ‘‘কী করব? মজবুরি হ্যায়।’’
মূল্যবৃদ্ধি, সন্তানদের ভবিষ্যৎ— কোনও কিছুরই মূল্য নেই এই মজুরিতে। সরকার এখানে ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে পারেনি। কিন্তু ৫৪২ কোটি টাকার বিনিময়ে গোটা চা বলয়ে হাজির করানো হয়েছে ‘ডিয়ার লটারি’কে।
আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিঙ ও জলপাইগুড়ি এই তিন লোকসভা কেন্দ্র জুড়েই ছড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গের চা বলয়। তিন লোকসভা কেন্দ্রেই ভোটারদের বড় অংশ চা শ্রমিক। আর সেখানেই বকেয়া পড়ে আছে ন্যূনতম মজুরি। বাগান শ্রমিকদের কাছে জমির দাবির সঙ্গে যুক্ত ন্যূনতম মজুরির লড়াই। সেই মজুরিতে সংসার চালানো ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে, তা উঠে আসে মহিলা শ্রমিকদের কথায়। ‘‘২৫০ টাকায় কী করে সংসার চলে? চলে না। লাইটের বিল আছে। গ্যাসের বিল আছে। ছেলেমেয়েদের পড়ানো আছে। এরপর কত টাকা পড়ে থাকে?’’ বলছিলেন ঊর্মিলা ওঁরাও। 
যৎসামান্য মজুরির পাশে সামান্য টাকা খরচে লটারি কাটার হাতছানি। বাগান ঝুঁকছে সেদিকেই। ‘‘চিট ফান্ডে টাকা রেখে মমতার আমলে একবার সর্বস্বান্ত হওয়ার পর গরিব মানুষ এখন প্রতিদিন সর্বস্বান্ত হচ্ছে। সবাই বলছে, লটারি কেটে প্রাইজ পেয়েছে। সেই প্রচারে বাকিরা আগুনের দিকে ছুটছে।’’ আলিপুরদুয়ার শহরের এক ব্যাঙ্ক কর্মচারী বলছিলেন। গোটা উত্তরবঙ্গ এখন লটারির গ্রাসে। 
চা বাগানের এমন কোনও জনপদ নেই, যেখানে একটা টুল নিয়ে করা হয়নি লটারি বিক্রির ব্যবস্থা। বাগানের বাইরে বাজার, হাট, বাসস্ট্যান্ড সব জায়গায় লটারি। যে দিকে পড়বে চোখ, সেখানেই চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি ডিয়ার লটারির। ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ এসে দাঁড়াবে পাশে। জানতে চাইবে, লটারি কিনবেন কি না। দূরপাল্লার উত্তরবঙ্গ পরিবহণের বাস আলিপুরদুয়ার ছেড়ে ফালাকাটা এসে পৌঁছানো মাত্র দরজার সামনে লটারির টিকিট নিয়ে দাঁড়ান কেউ না কেউ। এঁরা মূলত বয়স্ক। জলপাইগুড়ির দোমোহনি মোড়ে এমনই এক লটারি বিক্রেতা, নাম বলেছিলেন রমেশ ঘোষ। বলছিলেন, ‘‘দোমহনি বাজার থেকে জাতীয় সড়কের মোড় পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে লটারি বিক্রি করি। টুকটাক করে চলে যায়।’’ একদিকে কাজ না পাওয়া গরিব মানুষ বাধ্য হচ্ছেন লটারি বিক্রির পেশায় নামতে, অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরি না পাওয়া চা শ্রমিকরা ফোকটে টাকা পাওয়ার লোভে লাইন দিচ্ছেন লটারি কেনার লাইনে।
এক ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয়ের মুখে দাঁড়িয়ে গোটা একটা সমাজ। 
‘‘বাগানের ভিতরেও লোকজন টেবিল পেতে ডিয়ার লটারি নিয়ে বসে পড়ছে। আফিমের নেশার মতো হাজিরা (মজুরি) পাওয়ার পর শ্রমিকরা টিকিট কাটে। রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা থেকে চা বাগানের শ্রমিকরা সবাই ১০০ টাকা পর্যন্ত লটারির টিকিট কিনছে। সর্বনাশা নেশার মতো গ্রাস করেছে গোটা সমাজকে। বাগানও তার বাইরে থাকছে না।’’ বলছিলেন দার্জিলিঙ জেলা চিয়াকামান মজদুর ইউনিয়নের নেতা গৌতম ঘোষ। 
ন্যূনতম মজুরি নিয়ে টালবাহানা করে রাজ্য সরকার এখন মালিকদের স্বার্থরক্ষায় নেমে এককালীন ভাতা ঘোষণা করেছে। এক বছর আগে, গত ২০২৩ সালের ২৭ এপ্রিল ১৮ টাকা ভাতা বেড়েছিল চা শ্রমিকদের। ভাতার বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলায় গত বছর ১ আগস্ট রায় হয়েছিল, ছয় মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করতে হবে। গত ১ ফেব্রুয়ারি ছয় মাসের সময়সীমা পার হয়েছে। কিন্তু চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সরকার ঘোষণা করেনি। ২৪ ঘণ্টা আগে জলপাইগুড়ির সার্কিট বেঞ্চে ফের উঠেছিল চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির প্রসঙ্গ। আদালত আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ন্যূনতম মজুরির বিষয়টি বিবেচনার জন্য শ্রম কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছে। 
গোটা দেশে একমাত্র তৃণমূল-শাসিত পশ্চিমবঙ্গ ও বিজেপি-শাসিত আসামে চালু হয়নি চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি। দুই রাজ্যেই চা বাগান মালিকদের সংগঠন বলতে সিসিপিএ (কনসালটেটিভ কমিটি অব প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন)। এই দুই রাজ্যেই নেই চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি। বাগিচা শ্রমিকদের জয়েন্ট ফোরামের অন্যতম আহ্বায়ক জিয়াউল আলম জানালেন, ‘‘আসাম আর পশ্চিমবঙ্গেই চা বাগানে ন্যূনতম মজুরি নেই। আর এই দুই রাজ্যেই মালিকদের সংগঠন সিসিপিএ। কিন্তু দুই রাজ্যে সরকার ভিন্ন। চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার প্রশ্নে দুই সরকারের আচরণই সমান।’’ 
উল্লেখ্য, চা শ্রমিক আন্দোলনের চাপে ২০১৫ সালে রাজ্য সরকার তৈরি করেছিল ন্যূনতম মজুরি পরামর্শদাতা কমিটি। ছয় মাসের মধ্যে সেই মজুরি নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। তারপর থেকে নয় বছর। বাগান শ্রমিকদের কাছে অধরা ন্যূনতম মজুরি। 
 

Comments :0

Login to leave a comment