Leaps and Bounds

ভুয়ো কারবার থেকে তোলার টাকা, সবই ঢুকেছে অভিষেকের সংস্থায়

রাজ্য

Leaps and Bounds

নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে একাধিক সংস্থার নাম সামনে এসেছে। একাধিক সংস্থার মাধ্যমে স্বাধীনতার পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের বুকে সব থেকে বড় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে টাকা পাচার হয়েছে। ধৃত পার্থ চ্যাটার্জি ও অর্পিতা মুখার্জির যৌথ সংস্থা ‘এপিএ ইউটিলিটি সার্ভিসেস’ থেকে কালীঘাটের কাকুর ‘এসডি কনসালটেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড’ নামক সংস্থার নামও এসেছে চার্জশিটে।
কিন্তু ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’র নাম সামনে আসার পরেই ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী থেকে ভাইপো সাংসদ প্রকাশ্যেই তোপ দাগতে শুরু করেছেন কেন্দ্রীয় সংস্থার বিরুদ্ধে। ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’ সামনে আসতেই নিয়োগ কাণ্ডে মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে শুরু করেছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে দলীয় সভা থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ‘ আমার ফোনে একটা মেসেজ পাঠিয়েছে, অভিষেককে নাকি ভোটের আগে গ্রেপ্তার করে নেবে’। তার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই আবার নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি অমৃতা সিনহা ঐ লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে ইডির তল্লাশির পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন ঐ সংস্থার আরেক কর্ণধারকে তলব, গ্রেপ্তার করা হলে অভিষেক ব্যানার্জিকে সমন পাঠানো হবে না, কেন তাঁকে তলব করা হচ্ছে না আর?
স্বাভাবিক ভাবেই ফের সামনে এসেছে অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থা এই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের প্রসঙ্গ। ইডি’র একটির সূত্রের দাবি কয়লা পাচার থেকে নিয়োগ কাণ্ড বারেবারে সামনে এসেছে এই সংস্থা। এছাড়াও জন্মলগ্ন থেকেই এই সংস্থার একাধিক লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, খাতায় কলমে থাকলেও বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন সব সংস্থাকে ‘পরিষেবা’, ‘পরামর্শ’ দেওয়ার নামে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে ঢুকেছে কোটি কোটি টাকা যা আসলে আধুনিক তোলাবাজিরই নামান্তর!
আর সেই সূত্রেই সামনে এসেছে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের জন্মের পরেই একটি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের ঘটনা।
২০০৯ সালে ঘটেছিল ভাঙড় লাগোয়া বেদিক ভিলেজ কাণ্ড। মমতা ব্যানার্জি তখন রেলমন্ত্রী। বেদিক ভিলেজকাণ্ডে রাজারহাটের শিখরপুরে সামান্য ফুটবল খেলা থেকে বচসা এবং তার পরিণতিতে মাটি মাফিয়া গফফ্‌রের নেতৃত্বে গুলি, মৃত্যুর ঘটনায় রীতিমতো হইচই শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক মহলে। 
সেই ঘটনায় জমি লুট, জমি মাফিয়া কারবার, বেদিক ভিলেজে অস্ত্র রাখা, হামলা চালানোসহ একাধিক অভিযোগে সে সময় এমনকি রাজকিশোর মোদীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনআইএ তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন মমতা। তখন কথায় কথায় সিবিআই, এনআইএ তদন্তের দাবি তুলতেন মমতা ব্যানার্জি। সেসময়তেই বেদিক ভিলেজ কাণ্ডে রাজকিশোর মোদীকে গ্রেপ্তার এবং তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। বামফ্রন্ট সরকার রাজকিশোর মোদীকে গ্রেপ্তার করে, তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়, পরে জামিন পান।
কে এই রাজকিশোর মোদী? ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর বেদিক ভিলেজের মালিক রাজকিশোর মোদী এই সংস্থার ডিরেক্টর হন। বেদিক ভিলেজকাণ্ডে অন্যতম ‘অভিযুক্ত’, বামফ্রন্ট সরকারের সময়তেই জেল খাটা এই রাজকিশোর মোদীর রিয়েল এস্টেট সংস্থা থেকেও ‘বিনিয়োগের’ নামে বেমালুম কমিশন হিসাবে ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা চলে গিয়েছিল অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে। তখনও অভিষেক ব্যানার্জি ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’-র বোর্ড অফ ডিরেক্টরসের অন্যতম সদস্য। খোদ কোম্পানি বিশেষজ্ঞদের আরও বিস্ময়, আরওসি-র তালিকা অনুযায়ী যে সংস্থা ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে ইনকর্পোরেটেড হয়েছে সেই সংস্থাই ওই আর্থিক বছরেই সওয়া এক কোটি টাকা কমিশন পেয়ে গেল?
আরওসি বা কোম্পানি নিবন্ধকের তালিকায় দেখা গেছে অভিষেক ব্যানার্জির সংস্থার পারিবারিক সংস্থা ঐ ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ ২০১২সালের ১৯এপ্রিল নথিভুক্ত হয়েছে। সংস্থাটির কর্পোরেট আইডি নম্বর- ইউ ৭৪৯৯৯ ডব্লিউবি ২০১২পিটিসি ১৮০৯৭৫। এই সংস্থাটিরই চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট অশোক তুলসিয়ান। লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থাটি আরওসি-তে নথিভুক্ত হওয়ার মাত্র একমাস দশ দিন পরেই ওই সংস্থারই চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট অশোক তুলসিয়ান বেমালুম রাজকিশোর মোদীর সংস্থা গ্রিনটেক আইটিসিটি-র অন্যতম ডিরেক্টর বনে গেলেন। ২০১২সালের ২৯ মে। ওই আর্থিক বছরেই গ্রিনটেক সিটি থেকে ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা ঢুকে গেল লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে যার চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট সেই অশোক তুলসিয়ান।
আবার এক দশক পরে নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডের তদন্তেও দেখা গেছে ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমে ঘুরপথে টাকা ঢুকেছে অভিষেক ব্যানার্জির এই পারিবারিক সংস্থায় যেখানে এখনও তাঁর বাবা-মা’ই ডিরেক্টর!
ইডি’র দাবি, মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে দেখা গেছে ঘুরপথে অভিষেক ঘনিষ্ঠ কালীঘাটের কাকুর সংস্থা এসডি কনসালটেন্সির মাধ্যমেই ২০২০সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১’র জানুয়ারি পর্যন্ত তিন দফায় মোট ৯৫লক্ষ টাকা ঢুকেছিল লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে। কালীঘাটের কাকুর সংস্থা এসডি কানসালেটন্সিকে ‘পরামর্শ’ দেওয়ার বিনিময়ে এই টাকা দেওয়া হয় ব্যানার্জি পরিবারের সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসকে। 
ইডি’র দাবি, রিয়েল এস্টেটে খেটেছে নিয়োগ দুর্নীতির টাকা। একটি বড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কাছে ভুয়ো বিল জমা দিয়ে, কার্যত খাতায় কলমে লেনদেন দেখিয়ে ৯৫ লক্ষ টাকা মুনাফা করেছিল সুজয় ভদ্রের সংস্থা এসডি কনসালটেন্সি। মহিষবাথানে ঐ রিয়েল এস্টেট কোম্পানির এক প্রজেক্টে মাল সরবরাহের বরাত পাইয়ে দেওয়া হয় একটি সংস্থাকে। সেই সংস্থা ১ কোটি ৩৬ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকার বিল ধরায়। বিল হয়েছিল সুজয় ভদ্রের সংস্থা এসডি কনসালটেন্সির নামে। এরপরে ঐ রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কাছে আরেকটি বর্ধিত হারে বিল জমা দেওয়া হয়। ১কোটি ৩৬ লক্ষ হয়ে যায় ২কোটি ৩২লক্ষের বেশি আর ঐ ৯৫ লক্ষের বেশি টাকা সরাসরি ঢোকে সুজয় ভদ্রের এসডি কনসালটেন্সি সংস্থায়। এরপর ঐ টাকাটি সোজা চলে যায় লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে। গোটা কারবারটি শুধু খাতায় কলমে দেখানো হয়েছে। বানানো হয়েছিল ভুয়ো বিল। ঐ রিয়েল এস্টেট সংস্থাকে কালীঘাটের কাকুর সঙ্গে এই কারবারে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। ইডি’র কথা আসলে তা ‘প্রোটেকশন মানি’।
একদম এই একই প্রক্রিয়ায় আবার কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার ঘনিষ্ঠ একটি রিয়েল এস্টেট সংস্থার মাধ্যমে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের দুটি সংস্থায় ঢুকেছিল কয়লার টাকা। ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’- এই দুই সংস্থায়  একটি রিয়েল এস্টেট সংস্থার মাধ্যমে ঢুকেছে টাকা।  সেই সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যোগ লালার। অর্থাৎ কয়লা পাচারের টাকাই ঢুকেছিল ঘুরপথে, পরিমাণ ৪ কোটি ৩৭ লক্ষ।
স্বাভাবিকভাবেই তাই কয়লা থেকে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তের ভরকেন্দ্রে এখন এই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস।

 

Comments :0

Login to leave a comment