নলবন ফিশারিতে পাঁচিল দেওয়ার নামে শেষ পর্যন্ত পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে হাত দিল শাসক দলের জমি মাফিয়ারা। জলাভূমি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক মাপকাঠি ‘রামসার’ তালিকাভুক্ত এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকেও জমি মাফিয়ারা গ্রাস করতে উদ্যত হওয়ায় উদ্বিগ্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী সহ সাধারণ মানুষ।
স্টেট ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বা এসএফডিসি’র অধীন নলবন ফিশারিজে ইদানীং শুরু হয়েছে পাঁচিল তৈরির কাজ। আর তা করতে গিয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে ভেড়ি ছেঁচার কাজ। জেসিবি দিয়ে রীতিমতো উপড়ে ফেলা হচ্ছে বড় বড় গাছ। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করলেও শাসক-ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারকে কাজ থেকে বিরত রাখা যায়নি।
নলবন ভেড়িতে ফেব্রুয়ারিতে দেড় কোটি টাকার মাছ চুরি হয়ে গিয়েছে। এই জন্য না কি পাঁচিল দেওয়া হচ্ছে। আর সেই পাঁচিল দিতে গিয়ে নলবন সংলগ্ন সুকান্তনগরে বিস্তীর্ণ এলাকায় পুরানো গাছ জেসিবি দিয়ে উপড়ে ফেলা হচ্ছে। ২ ফেব্রুয়ারি থেকে জল ছেঁচার কাজ চললেও শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে গাছ কাটার কাজ। আর এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছেন সুকান্তনগরের বাসিন্দারা। তাঁদের একটাই কথা, ‘রামসার’ তালিকাভুক্ত এই এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করার অধিকার সরকারেরও নেই। সরকার সেই কথা মানতে নারাজ। তবু সুকান্তনগরের মানুষজন শুক্রবার গলা চড়াতেই সেখান থেকেই চলে যান ঠিকাদারের কর্মীরা। শনিবার সকালে ফের তাঁরা ফিরে এসে তিরিশ-চল্লিশ বছরের পুরানো গাছ কেটে উপড়ে ফেলার কাজ শুরু করেছেন।
একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি রামসারের তালিকাভুক্ত থাকার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে, আরেকদিকে সেই সরকারের অধীন সংস্থা এই জলাভূমির চরিত্র বদলের চেষ্টা করছে। এর আগেও শাসক-ঘনিষ্ঠ জমি মাফিয়ারা পূর্ব কলকাতা জলাভূমি দখলের চেষ্টা চালিয়েছে।
পূর্ব কলকাতা জলাভূমি নিয়ে এখনও প্রায় চারশো অভিযোগ পরিবেশ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এরপরেও এই ঘটনা ঘটছে। এলাকার বাসিন্দাদের মতে, ময়লা জলে মাছ চাষের ভেড়ি ভরে যাওয়ায় ৩-৫ বছর অন্তর ভেড়ির জল বের করে দেওয়া হয়। এরপর সেখানকার মাটিতে লাঙল দিয়ে তা শুকিয়ে ফের ময়লা জল ঢোকানো হয়। এটা ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। গত ফেব্রুয়ারি থেকে সেই কাজ করা হচ্ছিল। তাই সুকান্তনগরের মানুষরা প্রথমে চুপ ছিলেন। কিন্তু বড় বড় গাছ উপড়ে ফেলার কাজ শুরু হতেই তাঁরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন।
শনিবার আশপাশের বড় বড় গাছ উপড়ে ফেলার পাশাপাশি ভেড়িতে নামানো হয়েছে জেসিবি। রামসার তালিকাভুক্ত এলাকার ন্যূনতম আইনকানুন না মেনে এই কাজে জলাভূমির প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে বলেই পরিবেশবিদদের বক্তব্য। তাঁদের মতে, প্রাকৃতিক ও বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট করে এভাবে কোনও গাছ কাটা যায় না। আর খোদ সরকার যদি জলাভূমির চরিত্র বদলে সাহায্য করে, তার থেকে দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু থাকতে পারে না। কলকাতার বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় এই জলাভূমির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পূর্ব কলকাতা জলাভূমির এই নিধনে সরব হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ। ঘটনার খবর পেয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞান মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক প্রদীপ মহাপাত্র। তিনি এদিন বলেন, ভয়ঙ্কর ঘটনা। রামসার সাইটকে এইভাবে ধ্বংস করার অধিকার কারও নেই। এর প্রতিবাদে এবং অবিলম্বে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে রবিবারই পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ বিধাননগর বিজ্ঞান কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বিধাননগর দক্ষিণ থানায় ডেপুটেশন দিতে যাওয়া হয়, যদিও থানার পক্ষ থেকে আইন দেখিয়ে চিঠি গ্রহণ করা হয়নি। মঞ্চের পক্ষ থেকে শীঘ্রই বৃহত্তর আন্দোলনে নামা হবে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক মহাপাত্র।
নলবল ফিশারিজের বেশিরভাগ অংশ বিধাননগর কর্পোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের চিংড়িঘাটা থেকে যে রাস্তা নিক্কো পার্কের দিকে গিয়েছে, সেখান থেকে একটু এগলেই শুরু হচ্ছে ভেড়ি এলাকা। ওই এলাকায় শুধু জলাশয়ই নেই, রয়েছে প্রচুর মানুষের বাস। এলাকাটি সুকান্তনগর বলে পরিচিত। শোনা যাচ্ছে, নলবন ফিশারিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত বর্তমান আইএএস আধিকারিক এস বিশ্বনাথ এই গোটা কাজের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। তাঁরই পরিকল্পনায় না কি হচ্ছে পাঁচিল দেওয়ার নামে জলাশয়ের বিচ্যুতিকরণ ঘটানোর কাজ।
প্রসঙ্গত, ওডিশার চিল্কা হ্রদও এক সময়ে রামসারের তালিকাভুক্ত ছিল। তারপর ধীরে ধীরে বিচ্যুতি ঘটিয়ে তাকে রামসারের কালো তালিকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে দু’টি রামসার সাইট রয়েছে। একটি সুন্দরবন, অপরটি পূর্ব কলকাতার জলাভূমি। ২০০২ সালে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে প্রথমে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ‘রামসার সাইট’-এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায়। ২০১৯ সালে সুন্দরবন রাজ্যের দ্বিতীয় এলাকা হিসাবে রামসার সাইটে যুক্ত হয়। নলবন এবং গোলতলা নিয়েই গঠিত পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। রাস্তা বানানোর নামে আগেই গোলতলায় হাত পড়েছিল। এবার পড়ল নলবনে।
স্থানীয় মানুষরা জানতে পেরেছেন, নলবনের কিছু এলাকার জলাভূমি না কি ভরাট করে তৈরি হবে বিশাল পার্কিং লট। নিক্কো পার্ক সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত গাড়ি সেখানে রাখার ব্যবস্থা করে সরকার তা থেকে পার্কিং ফি সংগ্রহ করবে। এখন নলবনের ভেড়ির উপর হাত পড়েছে। এরপর জলা-খালের পাশে ঘর বানিয়ে থাকা গরিব মানুষদের সেখান থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করা হবে। আর সেখানেই আশঙ্কাটা আরও তীব্র হচ্ছে। তৃণমূল সরকারের তরফে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির উন্নতিকল্পে নানা সময় ‘মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করা হলেও তা আদপে বাস্তবায়িত হয়নি।
উলটে বারবার নানা অছিলায় জলাভূমির জমি হাতানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কলকাতা কর্পোরেশন ভেড়ি সংলগ্ন এলাকায় একবার পিচের রাস্তা তৈরির চেষ্টা করেছিল। স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদের পাশাপাশি পরিবেশ আদালতের হস্তক্ষেপে কলকাতা কর্পোরেশনের সেই অপচেষ্টা রোখা গিয়েছিল। এবার সেই কাজটি শুরু করল তৃণমূল পরিচালিত বিধাননগর কর্পোরেশন। আর সেই জন্যই হয়তো সুকান্তনগরের কাউন্সিলর জয়দেব নস্করের মোবাইল ফোন ছিল নিরুত্তর। বারবার ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। এলাকার মানুষের অভিযোগ শোনার জন্য এলাকাতেও পাওয়া যায়নি ওই পৌর প্রতিনিধিকে।
Comments :0