JHARGRAM CPI(M)

সন্ত্রাসের ভিটেয় হাতে ঘুরছে ‘বাপ-দাদাদের ঝান্ডা’

রাজ্য লোকসভা ২০২৪

প্রচারে জনতা বেরিয়ে কথা বলছেন সোনামণি মুর্মু টুডুর সঙ্গে। ছবি: প্রিতম ঘোষ

অনিন্দ্য হাজরা, ঝাড়গ্রাম

"আপনার শুনলে গল্পকথা মনে হবে, কিন্তু আমার ১৩ বছর আগেই মরে যাওয়ার কথা ছিল।"

ঝাড়গ্রাম থেকে উত্তর দিকে দহিজুড়ি থেকে কিছুটা এগোলে আঁধারিয়া। বিনপুর ১ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত অঞ্চল। ঝাড়গ্রাম শিলদাগামী রাস্তার ডানদিকে গ্রামের রাস্তা ধরার কিছু পরে কথায় কথায় এমনটাই  বলে ফেললেন কানাই বিষই।

মঙ্গলবার সকালে ঝাড়গ্রাম বিধানসভার দহিজুড়ি এবং আঁধারিয়া পঞ্চায়েতে প্রচার চালান ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী সোনামণি টুডু। সেই প্রচারের সঙ্গী ছিলেন কানাই বিষই। অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক। সিপিআই(এম) করার অপরাধে সাইকেল চুরি থেকে শুরু করে খুন, অগ্নিসংযোগের মত ১৯ টি মামলা ঝুলছে তাঁর ঘাড়ে।

কংসাবতী নদীর পশ্চিম পাড়ের  লালগড়, ধরমপুর, রামগড়ের মত পূর্ব পাড়ের দহিজুড়ি, আঁধারিয়ার মতো অঞ্চলগুলিও সাক্ষী থেকেছে তৃণমূল মাওবাদী যৌথ বাহিনীর সন্ত্রাসের।

ভয়ের আগল ভেঙে, সন্ত্রস্ত এলাকায় মানুষ ফের লাল ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিচ্ছে। ঝাড়গ্রাম জুড়েই, বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে তৃণমূল বা বিজেপি’র পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে দেখা মিলছে কাস্তে হাতুড়ি তারার।

সাময়িক স্থবিরতা কাটিয়ে, ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হয়েছে সন্ত্রাসের বদ্ধভূমি থেকেই। আঁধারিয়া অঞ্চলে মাওবাদী-তৃণমূল স্কোয়াডের হাতে খুন হয়েছেন দুই সিপিআই(এম) কর্মী। এলাকার অন্যতম সংগঠক কানাই বিষইয়ের বাড়ি আক্রান্ত হয় ২০০৯ সালে। উন্মত্ত বাহিনী গোটা পরিবার সুদ্ধ তাঁকে পুড়িয়ে মারতে ছুটে আসে। বাঁদরবনী গ্রামের বাসিন্দাদের তৎপরতায় প্রাণ বাঁচে কানাই বিষইয়ের। ২০১০ সালে দহিজুড়িতে আক্রান্ত হয় জোনাল কমিটির সম্পাদক অমিয় সেনগুপ্তের বাড়ি।

এরপর মেদিনীপুর শহরে অজ্ঞাতবাস। এক কাপড়ে ঘর ছাড়া গোটা পরিবার। এটিএম কার্ডও পুড়ে গিয়েছে বাড়িতে। নিরুপায় হয়ে এসবিআই’র দহিজুড়ি ব্রাঞ্চে টাকা তুলতে এসে কানাই বিষই জানতে পারেন, সুচিত্রা মাহাতোর হিট স্কোয়াড তাকে খুঁজছে। এবারেও স্থানীয়দের তৎপরতায় প্রাণে বাঁচেন তিনি।

বারবার সিপিআই(এম) নেতার জীবনরক্ষা করার খেসারত যদিও দিতে হয় দহিজুরি পঞ্চায়েতের একাধিক দরিদ্র গ্রামবাসীকে। বৃদ্ধ দেবেন রায়ের পরিবার মুখোমুখি হয় মাওবাদীদের গণ আদালতের নারকীয় অত্যাচারের। বয়সের কারণে দেবেন রায়কে কয়েক ঘা  লাঠির বাড়ি  মেরে ক্ষান্ত হলেও, তার ছেলেদের হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়। ঝাড়গ্রাম দূরের কথা, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও  নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি তাঁদের।

দেবেন রায়ের পরিবার যদিও এখনও সিপিআই(এম)'কে সমর্থন করেন। মঙ্গলবার নিজের বাড়ির উঠোনে প্রার্থীকে দেখে আবেগে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা তাঁর।

এখনো কেন সিপিআইএমকে সমর্থন করেন?  উত্তরে বৃদ্ধের বক্তব্য, চোখ খুলতে, মুখ খুলতে শক্তি জুগিয়েছিল এই পার্টি। নইলে আমাদের মতো গরিবদের এখনো জোতদারের চাবুক খেতে হতো।

ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে আদিবাসী পাড়ার মাঝে মাঝে রয়েছে মুসলিম পাড়াও। মধ্যবঙ্গের মতো এখানেও কাস্তে হাতুড়ি তারাকে নিয়ে রয়েছে বিপুল উন্মাদনা। পতাকা থাকলেও নেই আইএসএফের কর্মী। স্বাভাবিক রাজনৈতিক নিয়মে রয়েছে তৃণমূল। পোস্টার এবং সিল্কের পতাকা শাসক দলের তহবিলের শক্তির স্পষ্ট প্রমাণ।

আর বিজেপি? কেন্দ্রের শাসক দল রয়েছে ‘হুজুগেদের’ ভরসায়। বাঁদরবনিতে সোনামনি টুডুর প্রচার চলাকালীন বিজেপির খেয়াল হলো গ্রামে পতাকা লাগাতে হবে। একটি টোটোতে দু’জনকে নিয়ে শুরু হলো বিজেপি’র অভিযান। সঙ্গে মাইকে বাজছে ‘জয় শ্রীরাম’। পঞ্চাশের কাছে বাইকের স্রোতে সহজেই চাপা পড়ে যায় বিজেপির এই কৌশল।

গোটা প্রচারের যাত্রাপথে, মহিলারা বেরিয়ে এসে প্রার্থীর সঙ্গে দেখা করেছেন। সিপিআই(এম)’র মিছিল দেখে জনজাতি মানুষের অনাবিল হাসি, ঝাড়গ্রামে বেশ কিছু হিসেব ঘুরতেই পারে।

প্রচার শেষে দহিজুড়ি  মোড়ের কাছে এক সিপিআই(এম) সমর্থকের জমিতে পংক্তিভোজনের আয়োজন করা হয়। একশ কুড়িটি প্লেট কম পড়ে যেন সহজ নিয়মে। স্থানীয় বিনপুর এরিয়া কমিটির সম্পাদক, ঐক্য নামাতার কথায়, এদিনের গণভোজের সমস্ত উপাদান দহিজুড়ী বাজারের ব্যবসায়ীরা দান করেছেন।

এদিনের প্রচারের নেতৃত্ব দেন পার্থ যাদব, ঐক্য নামাতা, সুশান্ত কুন্ডু প্রমুখ।

ঝাড়গ্রামের পরিস্থিতির এই আপাত পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব হলো?

ঝাড়গ্রাম জেলার সম্পাদক প্রদীপ সরকারের কথায়, ‘‘আমাদের বহু সমর্থক, এমনকি যাঁরা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, স্বজন খুইয়েছেন, তাঁরাও নানা ভাবে বিভক্ত হয়েছেন পরবর্তী কালে। তাঁদের একটা অংশ কুড়মি সমাজের দিকেও গিয়েছেন। এখন কুড়মি নেতাদের দলে টানার খেলায় নেমেছে তৃণমূল ও বিজেপি। কিন্তু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। বহু মানুষ আমাদের কাছে এসে বলছেন, গ্রামের মানুষ চাপ দিয়ে বলছে যে বাপ-দাদাদের ঝান্ডাটা আবার তুলে ধর।’’

এখন সেই চাপ উপেক্ষা করা খুব একটা সহজ হচ্ছে না।

Comments :0

Login to leave a comment