গাজার শিশুরা নাম লিখে রাখছে হাতের তালু, কবজি, পায়ে। নিজেদের নাম। প্রায় খেলার মতো।
ইজরায়েলের বোমাবর্ষণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া মৃতদেহের যাতে পরিচয় পাওয়া যায়। শত শত দেহে এমনভাবে বিকৃত হয়েছে যে পরিচয় পাওয়াই যায়নি। শিশুরাও জেনে গেছে, শরীরের কোনও অংশে নাম পাওয়া গেলে তাদের বাবা-মা জানবেন। একজন-দু’জন নয়, গাজা জুড়েই শরীরেই পরিচয় লেখার এই মর্মান্তিক খেলা চলছে।
শুক্রবার পর্যন্ত গাজায় নিহত প্যালেস্তিনীয়ের সংখ্যা ৪১৩৭। তাদের এক হাজারের বেশি শিশু, আরও কয়েকশত অল্পবয়সি। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত বাড়ি থেকে উদ্ধার করে আনা জখম শিশু হাসপাতালের চিকিৎসককে প্রশ্ন করছে, ‘ডাক্তার, আমি কি বেঁচে আছি?’ কোনোক্রমে উদ্ধার করে পালানো বাবার কোলে শিশু প্রশ্ন করছে, ‘বাবা, আমরা কি মরে যাব?’
বেঁচে থাকা ও মৃত্যুর মধ্যে গাজায় এখন সামান্য দূরত্ব, নিরাপদ আশ্রয় বলে কিছুই নেই। হাসপাতালের পরে বৃহস্পতিবার অনেক রাতে ইজরায়েল আক্রমণ করেছে একটি গির্জায়। গাজার সবচেয়ে পুরানো গ্রিক অর্থোডক্স সেন্ট পরফিরিয়াস চার্চ। ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হওয়া ওই চার্চের ভিতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন কয়েকশত মানুষ। বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। চার্চটি ভেঙে দিয়ে ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর যথারীতি দাবি, গির্জা আমাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল না। কাছেই একটি রকেট মজুতের জায়গা ছিল। জেরুজালেমের গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের তরফ থেকে এই হামলার তীব্র নিন্দা করে বলা হয়েছে, একে মানবিকতাহীন যুদ্ধ অপরাধ ছাড়া কিছুই বলা যায় না।
ইজরায়েলের বোমাবর্ষণ অবশ্য থামেনি। গত ২৪ ঘণ্টায় সবেচেয়ে বেশি আক্রমণ হয়েছে খান ইউনিসে। উত্তর গাজা থেকে মানুষকে দক্ষিণে সরে যেতে বলেছিল ইজরায়েল। তারপর থেকে দক্ষিণেই আক্রমণ তীব্রতর করা হয়েছে। মিশরের রাফা সীমান্তে একটানা বোমাবর্ষণ চলছে, সেই অবস্থায় ওই সীমান্ত দিয়েই আন্তর্জাতিক সহায়তা পাঠানোর কথা হচ্ছে। ইজরায়েল নিজেরাই দাবি করেছে, বৃহস্পতিবার রাতে ১০০টি নতুন লক্ষ্যবস্তুতে তারা আক্রমণ করেছে।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতায় এক ধাপ এগিয়ে মিশরের ডাকে শনিবার কায়রোয় একটি শান্তি শীর্ষ বৈঠক হতে চলেছে। এই বৈঠকে যোগ দেবেন মিশরের রাষ্ট্রপতি আল সিসি, প্যালেস্তাইনের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস, জর্ডানের রাজা আবদুল্লা, বাহরিনের রাজা, কুয়েতের যুবরাজ, ইতালি, স্পেন, গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী, সাইপ্রাসের রাষ্ট্রপতি, দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি সিরিল রামফোসা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্সের বিদেশ মন্ত্রীরা, জাপান, নরওয়ের বিদেশ মন্ত্রীরা, ইউরোপীয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বিদেশ নীতি সংক্রান্ত প্রধান। যোগ দেবেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এই বৈঠকে ঐকমত্য প্রায় অসম্ভব, কেননা অনেক দেশই গাজায় ইজরায়েলী হানার তীব্র বিরোধী। আবার ব্রিটেনের মতো দেশ আছে যাদের প্রধানমন্ত্রী ইজরায়েলে সশরীরে হাজির থেকে সমর্থন জানিয়ে এসেছেন যুদ্ধ প্রয়াসে। তবে গাজায় মানবিক সাহায্য পাঠানোর বিষয়ে এই বৈঠক থেকে কোনও সমাধানসূত্র বেরোতে পারে। লক্ষণীয়ভাবে, এই বৈঠকে হাজির থাকছেন না মার্কিন প্রতিনিধি। আমেরিকা ইজরায়েলী যুদ্ধ অভিযানে নিজেকে পুরোই জড়িয়ে নিয়েছে। বস্তুত ইজরায়েলের যুদ্ধ মন্ত্রীসভার বৈঠকেও অংশ নিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি।
ইজরায়েল মাটিতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইজরায়েলী সংসদে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, ইজরায়েল তিন পর্যায়ের যুদ্ধে যাচ্ছে। প্রথমত, বিমান হানা ও মাটিতে আক্রমণ। দ্বিতীয়ত, গাজায় ঢোকার পরে কিছু প্রতিরোধ হবে, তা পরাস্ত করা। তৃতীয়ত, গাজার জীবনের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। এক নতুন ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ইজরায়েলের মধ্যে এই আগ্রাসনের প্রতিবাদ করলে কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। ইজরায়লের সংসদ সদস্য, কমিউনিস্ট পার্টির ওফের কাসিফকে সংসদ থেকে ৪৫ দিনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। কাসিফ প্রকাশ্যেই প্যালেস্তাইনের জমিতে ইজরায়েলের দখলদারির বিরোধিতা করছিলেন। ইজরায়েলের দখলদারিই যে প্যালেস্তাইন সঙ্কটের মূল কারণ, তা লাগাতার বলে গেছেন তিনি। সোশাল মিডিয়ায় সরকারের নীতির সমালোচনা করায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে শতাধিক ইজরায়েলী নাগরিককে। ৭০ জন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
Comments :0