JANA AJANA — TAPAN KUMAR BAIRAGYA / NATUNPATA - 8 SEPTEMBER

জানা অজানা — খড়ি নদীর দান নাদনঘাট / নতুনপাতা

ছোটদের বিভাগ

JANA AJANA  TAPAN KUMAR BAIRAGYA  NATUNPATA - 8 SEPTEMBER

নতুনপাতা / জানা অজানা

নাদনঘাটের ইতিবৃত্ত
তপন কুমার বৈরাগ্য

নাদনঘাট পূর্বে পূর্বস্থলী থানার অন্তর্গত ছিল।
বর্তমানে নিজস্ব থানা নাদনঘাট।পূর্ববর্ধমান 
জেলার কালনা মহকুমায় অবস্থিত।
নাদনঘাট নামকরণ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে।
কিছু লোক মনে করেন নাদন একটি বিশেষ্য
পদ।যার অর্থ মোটা লাঠি বা খুঁটি। নাদনঘাটের পাশ
দিয়ে বয়ে গেছে খড়ি নদী। সেই নদীর ডান পাশে ছিলো নদীর ঘাট। সেখানে বসতো বিরাট বাঁশের বাজার। সেখানে মুগ , মসুরের আড়ৎ ছিলো। সেই থেকে হয়তো নাদনঘাট নাম হতে পারে। আবার কেউ   কেউ মনে করতেন নাদ বংশের রাজত্ব কালে বড় বড় নৌকা যোগে এখান থেকে  ব্যবসা বাণিজ্য চলতো ।সেই থেকেই এর নাম হয় নাদনঘাট।বহু প্রাচীনকাল থেকেই নাদনঘাটের খড়ি নদীর উপর দিয়ে যাতায়াত করতো নোঙর ফেলা নৌকা।এগুলো বিরাট আকৃতির।পণ্য সামগ্রী আমদানি ও রপ্তানি করা হতো এই বজরাজাতিয় নৌকাগুলির মাধ্যমে। তাছাড়া এই নৌকাগুলির মাধ্যমে খড়, চাল, পাট,মুগ,মুসুর প্রভৃতি রপ্তানি করা হতো।বহু প্রাচীনকাল
থেকেই পয়লা মাঘ উতরান্তির স্নানের জন্য নাদনঘাটের
নদী পেড়িয়ে পুণ্যার্থীরা ছইওয়ালা গরুর গাড়ি করে
জালুইডাঙায় গঙ্গা স্নান করতে যেতেন।


নাদনঘাট ধান চালের ব্যবসার জন্য সারা পশ্চিমবঙ্গে
বিখ্যাত ছিলো।বহু প্রাচীনকাল থেকেই নাদনঘাট ছিলো
একটা জনপদ।গরুরগাড়ি নৌকা করে বহু দূরদূরান্ত
থেকে এখানে মানুষ আসতো।এখানকার মাটি ধান,
পাট চাষের খুব উপযোগি।বর্ধমানকে ধানের গোলা
বলা হয় এখানকার কথা মনে করেই। এখানে দুটি
খুব বড় রাইস মিল ছিলো।একটা নাদনঘাটের পশ্চিম
দিকে অপরটি নাদনঘাটের পূর্বদিকে সাহাজাদপুরে। 
আর একটি ছিলো কিছুটা দূরে ভৈদরপাড়ায়। 
এই সমস্ত রাইসমিলে বহু দূরদূরান্ত থেকে আসতো শ্রমিকেরা কাজের জন্য। এখনো এদের কিছু কিছু বংশধর এখানে স্থায়ীভাবে বাস করছে।এখানে সব ধর্মের মানুষ বাস করেন। এখানকার সিংহরায় পরিবার বহু প্রাচীনপরিবার।এই পরিবারের কার্তিকমাসের কালীপূজো
খুব ঘটা করে পালিত হতো। নাদনঘাটে বারোয়ারি তলায়
বহু প্রাচীনকাল থেকেই এখানে  জ্যৈষ্ঠমাসে ব্রহ্মা পূজা
অনুষ্ঠিত হতো। কয়েকরাত ধরেই এখানে বিনা পয়সায়
কলকাতার বড় দলের যাত্রা এই অঞ্চলের লোকেরা দেখতে পেত।তাছাড়া বাজার কমিটি,নাদনঘাট শাস্ত্রী স্মৃতি সংঘ থেকেও যাত্রা দেওয়া হতো।মানুষ সেখান থেকে পেত বাঁচার রসদ। 

এখানে এসেছেন মহানায়ক
উত্তম কুমার,ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়,
যাত্রার মহানায়ক তপন কুমার,স্বপন কুমার, জ্যোৎস্না
দত্ত,ছায়া দেবী,সন্ধ্যা রানি,সন্ধ্যা রায়,শান্তি গোপাল,
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে।
এখানে নদীর ধারে আছে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির ।
কার্তিকমাসে কালীপূজোর দিন এখানে ঘটা করে
পূজো হয়ে আসছে।তাছাড়া এই মন্দিরে নিত্যপূজাও
হয়।এখানকার হরিনাম তলায় বহুপ্রাচীনকাল থেকেই
দোলপূর্ণিমার একাদশী থেকে দোল পূর্ণিমা অবধি
হরিণাম বসে। বহুকাল আগে থেকেই নাদনঘাটের গাজন
উৎসব হয়ে আসছে। নাদনঘাট কালীতলায়ও একটা মন্দির আছে।
বর্তমানে নাদনঘাটের কালীতলার কাছে চৈত্রমাসের
প্রথম দিকে বসে ঘটা করে হরিনাম সংকীর্তন হয়।
বর্তমানে এখানে শ্রাবণমাসে ঝুলনমেলায় বিরাট
আকারের মেলা বসে। এই মেলা যেন এখানে সম্প্রীতির উৎসব হয়ে ওঠে।এখানকার প্রাচীন দূর্গাপূজা
মোদক বাড়ির এবং  হরিনাম তলার দূর্গাপূজো।
নাদনঘাট আগে ছিলো বিধান সভা কেন্দ্র। বর্তমানে
আর বিধান সভা কেন্দ্র নেই। এই বিধান সভা থেকে
জয়ী হয়ে অনেক বরেণ্য ব্যক্তি পশ্চিমবঙ্গের বিধান
সভায় গিয়েছেন। এখানে ভোটে জিতে একজন ব্যক্তি
বিধান সভার স্পীকারও হয়েছিলেন। তিনি হলেন
মনসুর হবিবুল্লাহ।


এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীও ছিলেন। তিনি হলেন
অবোধবিহারী পান্ডে মহাশয়।
এখানকা এক ব্যক্তিত্ব নবদ্বীপের পৌর সভায় উচ্চ পদে আসীন ছিলেন।এখানে ছিলেন
এক মানব দরদী ডাক্তার।যিনি ছিলেন 
মানুষের ভগবান। তাঁর নাম  ডা:ব্রজেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
নাদনঘাটের বিখ্যাত ছিল গলদা চিংড়ি । একটা ছড়ায়
উল্লেখ পাই --নাদনঘাটের বড় চিংড়ি  নদের বেগুন দিয়ে।
বড় বড় বাঁশ দিয়ে বাঁধ তৈরি হতো। তাতে আটকা
পড়তো চিংড়ি,বোয়াল,বড় বড় বেলে,ট্যাংরা প্রভৃতি
মাছ। এইসব মাছগুলো পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বাজারে
সরবরাহ করা হতো।নাদনঘাটের নদীতে আগে বর্ষাকালে
বহু ডলফিন দেখা যেতো। নাদনঘাটের ব্রীজ বেশিদিনের
পুরানো নয়। আগে নাদনঘাটে দুটো বাসস্ট্যান্ড ছিলো।
একটা নাদনঘাটের পশ্চিমদিকে।আর একটা নাদনঘাটের
পূর্বদিকে। যেটা ছিলো সাহাজাদপুরে। স্থলপথে গরুর
গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলে কিছু অটো চলতে শুরু করে।
সাহাজাদপুর থেকে অটোগুলো যেতো হেমাতপুর এবং
নাদনঘাট থেকে যেত কুসুমগ্রাম পর্যন্ত।তার বেশ কিছুদিন
পর নাদনঘাট থেকে বর্ধমান পর্যন্ত বাস এবং নাদনঘাট(সাহজাদপুর) থেকে কালনা নবদ্বীপের বাস।


আশির দশকের শেষের দিকে নাদনঘাটের ব্রীজ চালু হলে
বহু দূর দূরান্তের বাস সার্ভিস শুরু হয়।
আগে নাদনঘাটে বুধবার এবং রবিবার হাট বসতো
এখন নাদনঘাটে প্রতিদিনই বাজার বসে।
বর্তমানে নাদনঘাটে একটি সুপার মার্কেট আছে।
নাদনঘাট থেকে বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
এরমধ্যে কয়েকটি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে।যেমন--নাদনঘাট বার্তা, শাপলা ,শিশুমেলা, নতুন আলোকে প্রতিবন্ধী ।নাদনঘাট রামপুরিয়া বিদ্যালয়ের পত্রিকা উদয়াচল অনিয়মিত ভাবে প্রকাশ হয়। নাদনঘাট অন্নপূর্ণা বালিকা বিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীবর্ষ--২০১৯
স্মরণিকা তিষ্ঠ ক্ষণকাল প্রকাশিত হয়। নিয়মিতভাবে
প্রকাশিত হয় নন্দনঘাট সংবাদ,ছোটনদী,শাস্ত্রী স্মৃতি সংঘের মুখপত্র সূত্রপাত। বর্তমানে নাদনঘাটে অন্নপূর্ণা
বালিকা বিদ্যালয়,রামপুরিয়া উচ্চবিদ্যালয়,প্রাইমারী
বিদ্যালয় আছে। আই,আই,এম,সি রামকৃষ্ণ শিক্ষাঙ্গণ,নাদনঘাট রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সেবাশ্রম।নাদনঘাট শিশু ভারতী একাডেমি এখানকার উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান। নাদনঘাটে আছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ মন্দির
লক্ষ্মনজিউ মন্দির।সমুদ্রগড়ের রাজা রঞ্জিত ভট্ট ঠাকুরের
স্মৃতি বিজড়িত এই মন্দির। এখন প্রায় ধ্বংসের দিকে।
এখানে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করেন।
নাদনঘাটে বর্তমানে স্টেট ব্যাঙ্ক,ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক,বর্ধমান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক আছে। বর্তমানে নাদনঘাটে একটা হাসপাতালও গড়ে উঠেছে। এখানে বেশ কিছু মসজিদও আছে ।এখানে একটি সাব পোষ্ট অফিস আছে,রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত নাদনঘাট শাস্ত্রী স্মৃতি সংঘ আছে। একটা সমবায় সমিতি আছে। নাদনঘাটের আশপাশে বেশ কয়েকজন খ্যাতি সম্পন্ন নাট্যকার ,কবি,সাহিত্যিক অভিনেতাও আছেন।মিশর যেমন নীল নদের দান,নাদনঘাটও তেমনি খড়ি নদীর দান।

Comments :0

Login to leave a comment