MUKTADHARA / ANYA KATHA — Paramartha Banerjee

মুক্তধারা / অন্য কথা — চাঁদ নিয়ে কিছু মিছু

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA  ANYA KATHA   Paramartha Banerjee

মুক্তধারা / অন্য কথা

চাঁদ নিয়ে কিছু মিছু

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

এই তো সেদিন, ভারতের চন্দ্রযান-৩, মানবজাতির চন্দ্র অভিযানের ইতিহাসে, প্রথমবার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করল। এই সাফল্যর জন্য ইসরোর বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদদের উদ্দেশে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। তবে এই আনন্দঘন মুহূর্তের রেশ কাটতে না কাটতে, শুরু হয়ে গেল এক নতুন বিতর্ক এবং নিজের অজান্তেই সেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে জড়িয়ে গেল প্রখ্যাত অভিনেতা এবং চিত্র পরিচালক রাকেশ রোশনের নাম। সেইসব ঘটনা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর জানি। কিন্তু রাকেশ শব্দের অর্থ যে চাঁদ, সে খবর আমরা কতজন রাখি? আর চাঁদের আলো তো আমাদের যুগ যুগান্ত ধরেই রোশনাই দিচ্ছে।  সেক্ষেত্রে রাকেশ রোশন চাঁদে যান বা না যান তা নিয়ে এত কথার কী আছে বাপু! তিনি তো নিজেই চাঁদ হয়ে আলো বিকিরণ করছেন। অন্তত চলচ্চিত্রের আকাশে তো বটেই।

আবার, যে চাঁদে চন্দ্রযান পাঠিয়ে আমরা গর্বিত, সেই চন্দ্র আর পৌরাণিক দেবতা চন্দ্র এক নয়। পৌরাণিক হিন্দু দেবতা চন্দ্র হচ্ছেন চাঁদের অধিপতি এবং সাতাশ জন নক্ষত্র দেবীর স্বামী। দক্ষ রাজার সপ্তবিংশতি কন্যাকে তিনি বিবাহ করেন এবং রোহিণী হচ্ছেন চন্দ্র দেবের প্রধান মহিষী। চন্দ্রের চার সন্তানের নাম বুধ, ভারচাস, ভদ্রা, জ্যোৎস্নাকালী। পৌরাণিক দেবতা চন্দ্রের বিবাহ হয়, সন্তান হয়; বুধ তো আবার চন্দ্রের বিবাহ বহির্ভূত পুত্র। আকাশের চন্দ্রের পক্ষে কিন্তু বিবাহ করা সম্ভব নয়।

রোমান কিংবদন্তির বা পুরাণের দেবী হলেন Luna, রোমান পুরাণ মতে দেবী লুনা চাঁদে আধিপত্য করেন, সেই জন্য যিনি Moon তিনিই Luna.  হিন্দু পুরাণে যে চাঁদ পুংলিঙ্গ, রোমান পুরাণে তিনিই স্ত্রীলিঙ্গ। কোনও মানুষের মানসিক স্বাস্হ্যর বিশেষ অবনতি হলে, তিনি ইংরেজিতে Lunatic, আর বাংলায় চন্দ্রাহত।
গ্রিক এবং রোমান পুরাণে দেখা যায় Werewolves-এর কিংবদন্তি। Werewolf, আসলে মানুষ, যে Full moon বা পূর্ণিমা রাতে নেকড়ে বাঘে পরিণত হয়। দেশি, বিদেশি সিনেমাতেও আমরা দেখেছি Werewolf-এর কাহিনি। যদিও বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার বলেছেন, পূর্ণিমার চাঁদ, নেকড়ে বা মানুষের উপর কোনও প্রভাব ফেলে না। চাঁদকে তাই মোটেই ভৌতিক Werewolves  কাহিনির জন্য দায়ী করা চলে না। নদী, সমুদ্রের জলে জোয়ার ভাটার টানের জন্য কিন্তু পৃথিবীর বাইরের মহাকর্ষীয় শক্তির বিশেষত চাঁদের এবং সূর্যের আকর্ষণের প্রভাব অনস্বীকার্য।

 

চাঁদের কিছু প্রতিশব্দ এই ফাঁকে দেখে নেওয়া যাক।

চন্দ্র — সোম, রজনীকর, হিমকর, নিশাকর, শশধর, সুধানিধি, রাকেশ, নিশানাথ, ইন্দু, মৃগাঙ্ক, দ্বিজরাজ, কলাধর, সুধাংশু, নিশাকান্ত, রাকা, শীতাংশু, সুধাকর, অত্রিসুত, হিমাংশু, রজনীকান্ত, কৌমুদীপতি, কুমুদপতি, তারানাথ, তারাধিপ, তারাপতি, সিতকর, রাকাপতি, কলানিধি, কলাভৃৎ, পূর্ণেন্দু, অমা, দর্শ, দ্বীজেন্দ্র, শরদিন্দু, চাঁদ, বালেন্দু, নিশামণি, শশাঙ্ক, চন্দ্রিমা, শশী, অম্ভোজ, বিধু।

চাঁদের ‘সোম’  নামানুসারেই  সপ্তাহের  একটি দিনের  নাম  সোমবার রাখা হয়েছে।

চাঁদের আলো বা জ্যোৎস্নাও নামের বাহারে কিছু পিছিয়ে নেই।  

জ্যোৎস্না — জোছনা, চন্দ্রালোক, কৌমুদী, চন্দ্রিমা, চন্দ্রকিরণ, চন্দ্রিকা, চন্দ্রকর, চন্দ্রসুধা, চাঁদনি, কৈরবী, শশিকর, চন্দ্রাংশ, দীপিকা।

 

যতই হোক, চাঁদের আলো বলে কথা।

‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনা রে…’ মান্না দে’র সেই বিখ্যাত গানে বা কুমার শানুর গাওয়া, ‘মেরা চাঁদ মুঝে আয়া হ্যায় নজর…’, এই দুই গানেই গীতিকার চাঁদের সঙ্গে প্রেয়সীর তুলনা করেছেন, অর্থাৎ চাঁদ এখানে স্ত্রীলিঙ্গ। আবার সুকান্তর কবিতায় ‘পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। রবীন্দ্রনাথ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গানে, কবিতায় আমরা বারংবার দেখেছি চাঁদের উপমা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর কিশোর উপন্যাসের হাত ধরে, আমরা ঘুরে এসেছি চাঁদের পাহাড়ে। সেই পাহাড় যদিও আকাশের চাঁদে নয়, এই পৃথিবীরই আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত।
চাঁদকে আমরা মামাও বলেছি। চাঁদের বুড়িকে কল্পনায় দেখেছি চরকা কাটতে। শিশুদের আদর করে বলেছি, ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’।
কেউ অল্পেই আকুল হলে, তাকে দিয়েছি, ‘আউলিয়া চাঁদ’ নাম।

চাঁদবদন যেমন বলেছি, তেমন চাঁদবদনী বলতেও পিছপা হইনি। আমাদের নায়ক শশী কাপুর যেমন আছেন, তেমনই নায়িকা বা খলনায়িকা শশীকলা একই আকাশে বিরাজমান। চাঁদ নিয়ে আমাদের উন্মাদনা শেষ হওয়ার নয়।

এই রম্যরচনা, চাঁদমারিতে সফল হয়ে যদি পাঠককুলের চাঁদ মুখে হাসি ফোটাতে পারে, তবেই আমার চন্দ্রাভিযান সাফল্যের চাঁদ হাতে পাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

Comments :0

Login to leave a comment