মুক্তধারা
প্রবন্ধ
'জীবনসূর্য, বাজায় তূর্য': ভবানীপ্রসাদ মজুমদার স্মৃতি
সৌরভ দত্ত
সৌ র ভ দ ত্ত
প্রতিভাধর মানুষগুলো কিভাবে হঠাৎ হারিয়ে যান মনুষ্যেতর পৃথিবী থেকে–এ আসা-যাওয়া যেন চলতেই থাকে।এক্ষেত্রে কোন যুক্তিতর্ক চলে না।হাজার নক্ষত্রময় ছড়ার পঙক্তি ছড়ানো ভাসমান একটা আকাশ যেখান থেকে সদ্য হারিয়ে গেলেন ভবানীপ্রসাদ।মনে পড়ে, তখন সবে ক্লাস টুয়েলভ।একটু আধটু লেখাজোখা করি।বাদল কাকা একটা ডোমজুড় বইমেলা থেকে একটা ছড়ার বই উপহার দিয়েছিলেন–"জীবনসূর্য বাজায় তূর্য"।অদ্ভুত ছন্দের স্বপ্ন বুননে উৎসাহী পাঠককে নষ্টালজিক সেই ছড়াগুলি।মূলত বাংলা ভাষার অমর্যাদা ও উপেক্ষার দিকটি উন্মোচিত হয়েছিল বইটির মধ্যে।বেশকিছু বছর যত্ন করে রাখলেও বইটি পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেননি এক প্রথিতযশা আবৃত্তিকার।
ভবানীপ্রসাদ বাবুর সাথে একটি স্মৃতিময় ঘটনা উল্লেখ করি।একবার মাজু সংস্কৃতি মেলার কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং ঠিক হয় ছড়াকার ভবানীবাবুকে দিয়ে মেলার উদ্বোধন করা হবে।স্মরণিকা উপসমিতির দায়িত্ব থাকায় আমার উপর কমিটির তরফে ভার দেওয়া হয় ভবানীবাবুর সাথে যোগাযোগ করে রাজি করানোর।আমার কাছে তাঁর কোনো ফোন নম্বর নেই।সাতপাঁচ ভেবে উপায় বের করি জহিরুল হাসানের সাহিত্যের ইয়ারবুক থেকে নম্বর জোগাড় করি।পরদিন হাওড়া-আমতা লোকালে বেলায় সোজা গিয়ে পৌঁছাই শানপুরের বাড়িতে।দরজা খোলেন ভবানীবাবুর সহধর্মিনী।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মেলা উদ্বোধনের বিষয়টি ওনাকে জানানোয় উনি ভিতরে নিয়ে যান।ঘর থেকে চোখে চশমা,শ্যামবর্ণ,গায়ে সাদা গেঞ্জি ও কালো প্যান্ট পরিহিত ভবানীবাবু সটান বেরিয়ে আসেন।ভিতরের ঘরে বসতে দেয় সারা ঘরে স্তূপাকারে বই টেবিলে শারদীয় সংখ্যা ছড়াছড়ি।তিলধারণের জায়গা নেই।প্রাথমিকভাবে ওনাকে মাজু সংস্কৃতি মেলা উদ্বোধনের জন্য অনুরোধ করি।উনি হাত বাড়িয়ে দেওয়াল ক্যালেন্ডার দেখে বলেন–ওইদিন ওনার একটি অন্য অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ রয়েছে।আমি কিছুটা বিমর্ষ ও হতাশ হতে দেখে উনি বলেন–"চিন্তার কিছু নেই তুমি একটা কাজ করো ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনেছো তো?পাণ্ডব গোয়েন্দা খ্যাত।ষষ্ঠীবাবু নিপাট ভদ্র মানুষ ওনাকে আমি বলে দিচ্ছি। তুমি যদি একটা আমন্ত্রণ চিঠি এনে থাকো ওটা নিয়ে ষষ্ঠীপদবাবুর বাড়ি চলে যাও ওনাকে আমি সব বলে দিচ্ছি উনি না করবেন না।এরপর ল্যান্ডফোন থেকে ফোনে ষষ্ঠীবাবুকে বলেন আমি একজনকে পাঠাচ্ছি আপনার কাছে।মাজু মেলার উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ পত্র নিয়ে যাচ্ছে।আপনি ওই মেলাটার উদ্বোধনটা করে দিন।" এই হচ্ছে চাকচিক্যহীন,একেবারে সাদামাটা আন্তরিক মনের মানুষ ভবানীপ্রসাদ ।এরপর সময় নষ্ট না করে ষষ্ঠীপদ বাবুর বাড়ি গিয়ে ওনাকে উদ্বোধনের প্রস্তাব দিতেই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান।সে বছর ভবানীপ্রসাদ বাবুর কথাতেই ষষ্ঠীবাবু মাজু সংস্কৃতি মেলার উদ্বোধন করেছিলেন।মাঝে যখন 'সৌহৃদ' পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলাম ভবানীবাবু একটা ছড়া লিখে দিয়েছিলেন।কাউকে বই উপহার দিলে ছড়াভঙ্গিতে দু-কলি শুভেচ্ছা লিখে দিতেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।মাঝে বেশ কিছুদিন তাঁর খোঁজ খবর রাখতে পারিনি।পরে যখন শুনি ওনার পায়ে অপারেশন হয়েছে একদিন ফোনে কথা হয়েছিল অশ্রুসিক্ত কিছুটা জড়ানো সে কন্ঠ।লেখার পাশাপাশি ভবানীপ্রসাদ বাবু সামাজিক ঋণ শোধের কথা ভেবে অনেক আগে মরনোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন।হাওড়া তথা পশ্চিমবঙ্গের শিশু-কিশোরের হৃদয়ে চিরজীবিত থাকবেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার ।
Comments :0