মুক্তধারা
প্রবন্ধ
জলাভূমি পরিবেশের কিডনি; জলাভূমি ধ্বংস করে কখনোই নাগরিক উন্নয়ন করা উচিত নয়
সৌরভ দত্ত
"আজ তিনি নবরূপী দানবের বংশে
মানুষ পাঠিয়েছেন মানুষের ধ্বংসে।"
–(রবীন্দ্রনাথ/'ধ্বংস' গল্প।)
রবীন্দ্রনাথের ধ্বংস গল্পের এ উপসংহারে যন্ত্র সভ্যতায় বলীয়ান মানুষের হাতে পরিবেশ ধ্বংসের
হাহাকার ব্যথাতুর করে আমাদের।সম্প্রতি আরো একটা বিশ্ব জলাভূমি দিবস চলে গেল।আধুনিক মানব সভ্যতায় জলাভূমি হ্রাসের নেতিবাচক দিকটি পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের চিন্তার আকাশে উঁকি মারছে। প্রাকৃতিক জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জলাভূমির গুরুত্ব চর্চিত হওয়া উচিত।পরিবেশের স্থানিক জীবজ বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষার তাগিদে জলাভূমি সংরক্ষণে জোর দেওয়া মানবিক কর্তব্য ।অর্ধ শতাব্দী আগে সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালে কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী ইরানের রামসার শহরে পরিবেশ সম্মেলন থেকে জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য চুক্তি সাক্ষর করা হয়েছিল।সেই মতো পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে রামসার কনজারভেশন চুক্তি সাক্ষরিত হয়।বিশ্বের প্রায় ১২৭টি দেশ এই চুক্তিপ্রক্রিয়া মেনে চলে।বর্তমানে অতি দ্রুত নগরায়ণ, নির্বিচারে জলাজমি অধিগ্রহণ, জলাভূমিতে দূষিত প্লাস্টিকজাতীয় বর্জ্য নিক্ষেপ প্রভৃতি একাধিক কারণে জলাভূমিগুলি আমাদের ভূগোল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।একসময় ভারতের বৃহত্তম রামসার সাইট ছিল সুন্দরবন।সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য বা লবণাম্বু উদ্ভিদকূল বিভিন্ন বন্যা,সাইক্লোনের মতো একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করত।কিন্তু বর্তমানে ম্যানগ্রোভ অরণ্য বেশিরভাগটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।ফলত বিভিন্ন প্রকৃতিক বিপর্যয়ের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সভ্যতার বুকে।
পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম রামসার সাইট হল–পূর্ব কলকাতা জলাভূমি।কলকাতা,হাওড়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় উন্নয়নের নামে জলাজমির ভূমিরূপ পরিবর্তন করে জলাজমি বুজিয়ে বেআইনি নির্মাণ, সারি সারি কলকারখানা, আবাসন প্রভৃতি গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে।সেজন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী পরিবেশ সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে জলাভূমি বাঁচানোর ডাক দিয়ে প্রতি বছর ২রা ফেব্রুয়ারি দিনটিতে– স্কুল কলেজগুলিতে সেমিনার,পদযাত্রা,জলাভূমিতে কচ্ছপের পুনর্বাসন,নদীবক্ষে নৌকোবাইচ,জলাভূমি রক্ষার্থে ড্রয়িং ও পোস্টার নির্মাণ, প্রভৃতি একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।বাস্তুতন্ত্রে জলাভূমি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।বর্তমান সভ্যতায় জলজ প্রাণীকে রক্ষা করা এবং পরিবেশের অতিরিক্ত কার্বন শোষণের জন্য এ মুহূর্তে জলাভূমির বিকল্প কিছু নেই।তাই জলাভূমিতে জলের সংরক্ষণ দরকার। কারণ সেখানে পরিশ্রুত পানীয় হিসেবে জল ধরে রাখলে দৈনন্দিন প্রয়োজনে এর ব্যবহারিক গুরুত্ব অপরিসীম।আজকের দিনটির গুরুত্ব জনমানসে বেশি করে বোঝানো দরকার।বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ডা.সাথী নন্দী চক্রবর্তী (সভাপতি,ফিউচার ফর নেচার ফাউন্ডেশন ) জলাভূমি দিবসের গুরুত্ব প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন –"জলাভূমি হল আমাদের পরিবেশের কিডনি। ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড অঞ্চলে প্রচুর জলাভূমি আছে।প্রতি বছর ২রা ফেব্রুয়ারি এই জলাভূমি দিবস পালন করা হয়।এবারের জলাভূমি দিবসের থিম–'ওয়েটল্যান্ডস্ অ্যান্ড হিউম্যান ওয়েলবিইং'। জলাভূমি আমাদের মানসিক,শারীরিক ও পরিবৈশ্বিক সম্পর্কযুক্ত।জলাভূমিতে জল ও জল-জন্তু সংরক্ষণ ভীষণভাবে আবশ্যক।সমস্ত জায়গায় জলাভূমিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে রাখা দরকার।জলাভূমির ছোট ছোট প্রাণীগুলিকে বাঁচিয়ে রাখলে বাস্তুতন্ত্রও রক্ষা পাবে।জলাভূমি ধ্বংস করে কখনোই আরবান ডেভেলপমেন্ট করা উচিত নয়।" বিশ্বায়নের যাঁতাকলে পিষ্ট মানব সভ্যতায় যেভাবে দিগ্বিদিকে জলাভূমি, অরণ্যসম্পদ গ্রাস করছে কিছু পুঁজিপতি। তাতে করে বেশ চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কপালে।এভাবে চলতে থাকলে শেষের সেদিন ভয়ংকর হয়ে উঠবে।একদিন টাইটানিকের মতো আস্ত পৃথিবীটা তলিয়ে যাবে কালের গর্ভে।
Comments :0