NATUN BANDHU — SANJBATI PAL / 22 Sharbon

নতুনবন্ধু — সাঁঝবাতি পাল / বাইশে শ্রাবণ

ছোটদের বিভাগ

NATUN BANDHU    SANJBATI PAL  22 Sharbon

নতুনবন্ধু

বাইশে শ্রাবণ
সাঁঝবাতি পাল

শুয়ে শুয়ে  ফ্যানের ব্লেড গুনে যাচ্ছি কেবল।কি বলবো,কি লিখবো ভেবে পাচ্ছিনা কিছু।দিদুন ডেকে বলেছে "আমি শুনেছি তুমি লেখো,মা বলেছে আমাকে।কাল দাদুভাইকে একটা কিছু শোনাবে না?"
না বলা অভ্যাস নেই।আর আপাতত চোখে ঘুম নেই।একটু গুছিয়ে বলি...দাদুভাই গানের শিক্ষক।এ শহরে সবাই এক ডাকে যাঁকে এই পরিচয়েই চেনেন।যতবার মামাবাড়িতে এসেছি,দেখেছি সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় গানের ক্লাস।গান বলতে কেবল রবীন্দ্রসংগীত বোঝে দাদু।স্নান করে ফুল দেয় কবিগুরুর পায়ে...দুপুরে চেয়ারে হেলান দিয়ে যখন ঘুমোয় দেখি বুকের ওপর গীতাঞ্জলি উপুড় করে রাখা।সব সমস্যার সমাধানে মাথায় হাত দিয়ে বলতেন..
"আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া"
বুঝতাম না ছোটবেলায়।আজ ও কতটা বুঝেছি কে জানে।তবে দাদু এখন আর বলতে পারেনা।হঠাৎই গান শেখাতে শেখাতে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে।হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে তবে গান গাওয়া বন্ধ হয়ে যায় চিরকালের জন্য।কি যেন নার্ভের সমস্যা।বুঝতে পারিনা ওই কঠিন শব্দগুলো।আমি শুধু দেখি আকাশবাণীতে  যখন গান বাজে 
"জীবন যখন শুকায়ে যায়,করুনাধারায় এসো"...দাদুর গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
কাল বাইশে শ্রাবণ।কবিগুরুর প্রয়ান দিবস।দাদু প্রত্যেকবছর পালন করত,এবছর বলেনি কিছু,কিন্তু আমরা ঠিক করেছি আমরা পালন করব ।একেবারে আগের মত করেই।সেই জন্যই আজ আমরাও এসেছি এখানে।দাদুর সমস্ত ছাত্রছাত্রী,বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে কবিগুরুকে স্মরণ করা হবে যেমনটি প্রত্যেক বারে হয়।তাই দিদুর দাবি এই নিয়ে কিছু একটা লিখে শোনাই আমি।


কিন্তু কি লিখবো? কীই বা জানি কবিগুরুকে নিয়ে?যতবার ডুব দিয়েছি  সেই খোঁজে কেমন তলিয়ে গিয়েছি তাঁর মধ্যেই।ডুবতে চাইলে তিনি যেন অতল সাগর ।মাথা তুলে দেখতে চাইলে অসীম পর্বত। আজ যদি দাদুকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম...হঠাৎ কি মনে হল,উঠে পড়লাম।দাদুর রুমের দিকে যেতেই দেখি তখনও আলো জ্বলছে।হাতের উপর হাত রেখে দাদু সামনে তাকিয়ে রয়েছে ।আমি পাশের চেয়ারটা টেনে বসলাম।দাদু তখনও স্থির আগের মতোই।হলদে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পাশেই খোলা আছে সঞ্চয়িতা।বোধ হয় শেষ পৃষ্ঠা...
"দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে
এসেছে আমার দ্বারে;
একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু
কষ্টের বিকৃত ভান,ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত-
অন্ধকারে ছলনার ভূমিকা তাহার।"
বুঝতে পারিনি কখন জোরে জোরে পড়া আরম্ভ করেছি,চোখ তুলতেই দেখি দাদু আমার দিকে তাকিয়ে,জলে ভিজে আছে গাল,চকচক করছে চোখ।মাথাটা হেলিয়ে দিলাম দাদুর গায়ে...
"বাইশে শ্রাবণ নিয়ে আমি কি বলতে পারি দাদুভাই,যেটা আর কোনোদিন কেউ বলেনি?"
দুজনেই চুপ।নিস্তব্ধতা ভেঙে বাইরের বড়রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝেই গাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে।ফ্যানের হাওয়ায় উড়ছে সঞ্চয়িতার পাতা।জানি উত্তর আসবেনা...তবু সময় গুনছি।হঠাৎ দাদু ড্রয়ার খুলে একটা ডাইরি এগিয়ে দিল আমার দিকে।তার ওপরটা সবুজ।সোনালী কিছু লেখা ছিল যা উঠে গেছে প্রায়।মাথায় হাত বুলিয়ে দাদু ইশারায় ঘুমিয়ে যেতে বলল।কেন জানিনা ফিরে আসতে ইচ্ছে করছিল না,তবু ডাইরিটা নিয়ে চলে এলাম রুমে।বিছানায় শুয়ে পড়া শুরু করলাম।প্রথম পাতায় লেখা...
"তুমি কি করেছ মনে,দেখতে পেয়েছ তুমি
সীমারেখা মম?
ফেলিয়া দিয়েছ মোরে, আদি অন্ত শেষ করে
পড়া-পুঁথি সম?
নাই সীমা আগে পাছে,যত চাও তত আছে
যতই আসিবে কাছে তত পাবে মোরে"
মনে মনে হাসলাম।নিজেকে কবি কি ভীষন চিনেছিলেন।ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই।


চিৎকার,চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙলো।আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম দাদুর ঘরে প্রচুর লোক।ভেতর থেকে দিদুনের কান্না।বাবা মা ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক করছে।রুমে ঢুকতেই মনে হল কে যেন চেপে ধরেছে গলা।আমি নিশ্বাস নিতে পারছিনা।কাঁদতে পারছিনা চিৎকার করে।হঠাৎ কিভাবে এসব হয়ে গেল দাদুভাই?! দাদা বলছিল "চা দিতে এসে দিদুন দেখে টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ।ভেবেছে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো।অনেকবার ডাকতেও যখন সাড়া দিচ্ছে না দিদু আমাকে ডেকে আনলো পাশের ঘর থেকে...কাল ও তো সুস্থ ছিল বল?"
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে।ভালো লাগছেনা চারপাশটা।নিজের ঘরে ফিরে এলাম।কিভাবে ভাববো কাল যে মানুষটা...সামনেই রাখা আছে সবুজ ডাইরিটা।ভালো করে দেখলাম,ভেতরে পেন রাখা আছে একটা পাতায়।এটাই বুঝি পড়তে বলেছিল দাদু? 
ওপরে কালকের তারিখ দেওয়া।লেখা আছে...
"আমার বয়স তখন বারো।যতবার ছেলেবেলা পড়েছি মনে হয়েছিল তুমি আমারই বয়সি।ধীরে ধীরে সময় এগিয়েছে।আমার সাথে সাথেই যেন বড় হয়েছ তুমিও।তারপর গান গাইতে শিখলাম।গান গাইতে গাইতে চোখ বন্ধ করে দেখতে পেতাম তুমি আমার সামনে বসে।তোমার পরনে সেই নাটকের পোশাক..."বাল্মীকি প্রতিভা"।মাথা নত হয়ে এসেছে।গলা বুজে এসেছে আবেগে।
এভাবেই পেরিয়ে যাচ্ছিলাম বেশ জীবনের চড়াই-উৎরাই।তুমি সাথে ছিলে সর্বক্ষণ।ভীষন আঁধারে,ঝলমলে সকালেও।হঠাৎ কি হল জানিনা বিধাতার যেন সহ্য হল না এ সুখ।আজ নিয়ে আট মাস বারো দিন আমি তোমার গান গাইতে পারিনি।এ পৃথিবীর সব-ই যেন শব্দে মুখর।বেগবান নদী,ঝড়ের হাওয়া,পশু পাখি,সন্ধে বেলা ঘরে ঢুকে পড়া ফড়িং,এমনকি আমার ঘরের পাখাটিও।

কেবল আমিই যেন নিস্তব্ধ,নিশ্চুপ।রোজ ভেবেছি আজ কি তোমায় দেখতে পাবো চোখ বুজলে? নাহ,তুমি আসোনি।গলার কাছে কেমন যেন যন্ত্রনা।নাকি এ ব্যথা একান্তই অন্তরের জানিনা।বারবার চিৎকার করে গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করেছে,সে তো দূর এ যন্ত্রনা তোমায় উজাড় করে কাঁদতেও পারিনি আমি।
আর যেন পারছিনা।এ কেবল এক নিথর দেহ...ক্লান্তি ছাড়া অনুভব করেনা কিছুই।কাল আবার নতুন করে তুমি ছেড়ে চলে যাবে আমায়...নতুনভাবে একা হয়ে যাবো আবার...আমার যাওয়ার সময় কবে হবে কবি...কেন তোমার সাথেই নিয়ে চলো না আমায়!"
বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে।হঠাৎ কীর্তনের আওয়াজে ঘোর কাটলো আমার।ওপর থেকেই দেখলাম দাদুকে নিয়ে যাচ্ছে ওরা...তখন থেকেই বারবার মনে পড়ছে কবি শ্রীজাত-র লেখা একটা কবিতার লাইন...শেষবেলায় সেটুকুই তোমাকে শোনালাম দাদুভাই...
"আবার কখনও যদি দেখা হয় অচেনা রাস্তায়
থেমে দুটো কথা বলবো
ফের চলে যাবো অন্যদিকে।
আজ তুমি সাবধানে যাও
মেঘেরা যেভাবে চলে যায়
একটু তো হবেই বৃষ্টি শ্রাবনের বাইশ তারিখে"

Comments :0

Login to leave a comment