ডাক্তারি পাঠক্রমে ভর্তির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা নিটে বেনিয়মের অভিযোগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে তদন্তের দাবি তুলল কংগ্রেস। শুক্রবার এই দাবি জানিয়ে কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, মোদী সরকারের আমলে বহু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে প্রশ্নপত্র ফাঁস, রিগিং এবং দুর্নীতি। নিটেও একই অভিযোগ উঠেছে। এর জন্য মোদী সরকার সরাসরি দায়ী। বিজেপি তরুণদের সঙ্গে প্রতারণা করছে এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলছে। দেশের যে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা নিট এবং অন্যান্য পরীক্ষা দিয়েছে, তারা যাতে ন্যায়বিচার পায়, তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া দরকার। একই দাবি জানিয়েছেন কংগ্রেসের নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ এবং অন্যতম মুখপাত্র রণদীপ সূর্যেওয়ালাও। নিটের ফল প্রকাশের পরে বেনিয়মের যা যা অভিযোগ উঠেছে, এদিনই এসএফআই’র পক্ষ থেকেও সেগুলির নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।
এমবিবিএস-বিডিএস’র স্নাতক পাঠক্রমে ভর্তির এই বছরের সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা নিটের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ৪ জুন, যেদিন লোকসভা ভোটের ফল ঘোষণা হয়েছে। নিট প্রথমে জানিয়েছিল, নিটের ফল প্রকাশিত হবে ১৪ জুন। তারপর হঠাৎই ৪ তারিখে তা ঘোষণা করে দেওয়া হয়। তারপরেই পরীক্ষার্থীরা একাধিক বেনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। নিট মোট ৭২০ নম্বরের পরীক্ষা। ১৮০টি প্রশ্ন থাকে, প্রতিটি ৪ নম্বরের। প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য মোট প্রাপ্ত নম্বর থেকে ১ নম্বর করে বাদ যায়। এর অর্থ, সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলে এক জন পরীক্ষার্থী সর্বোচ্চ ৭২০ নম্বর পেতে পারে। ন্যূনতম একটি প্রশ্নের উত্তর ভুল হলেই তার পাওয়ার কথা ৭১৫। অথচ এবার প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গিয়েছে, কেউ কেউ ৭১৮ বা ৭১৯ পেয়েছে, যা একেবারেই অসম্ভব। নিট পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি বা এনটিএ’র বক্তব্য, এবার কোথাও কোথাও প্রশ্নপত্র দেরিতে পৌঁছেছে বলে সেখানকার পরীক্ষার্থীদের গ্রেস নম্বর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার আগে নিটের বিজ্ঞপ্তিতে এনটিএ কোথাও কোনও কারণে গ্রেস নম্বর দেওয়া হতে পারে বলে জানায়নি। তা ছাড়াও যেখানে প্রশ্নপত্র দেরিতে পৌঁছেছে, সেখানে কেন দেরিতে পৌঁছালো আর কেনই বা পরীক্ষার্থীদের অতিরিক্ত সময় না দিয়ে গ্রেস নম্বর দেওয়া হলো, তার কোনও সদুত্তর এনটিএ এখন পর্যন্ত দিতে পারেনি। উপরন্তু এবারই প্রথম নজিরবিহীনভাবে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ নম্বর ৭২০ পেয়েছে ৬৭ জন। তাদের মধ্যে ৮ জন আবার একই কেন্দ্রে বসে পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা পর্বে নিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগও উঠেছিল, যদিও এনটিএ তা মানতে চায়নি। এক বা একাধিক কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যোগসাজসে পরীক্ষার ফলে কারচুপি করা হয়েছে , মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কোনও কোনও কোচিং সেন্টারকে প্রশ্নপত্র আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশেষ বিশেষ পরীক্ষার্থীদের বেআইনিভাবে গ্রেস নম্বর দেওয়া হয়েছে এবং নিটের ফলাফলে বিরাট দুর্নীতি হয়েছে বলে পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অনেকের তরফেই সোস্যাল মিডিয়ায় অভিযোগ তোলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ৫ মে নিট হয়েছিল, কেন্দ্রে তখন ক্ষমতায় আগের মোদী সরকার।
শুক্রবার সোস্যাল মিডিয়া এক্স-এ একের পর এক পোস্টে গোটা বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছেন কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ, নিটে বেনিয়মের অভিযোগ নিয়ে কার্যত তুলোধনা করেছেন মোদী সরকারকে। খাড়গের পাশাপাশি কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেছেন, প্রথমে নিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এবং তারপরে ফলাফলে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে পরীক্ষার্থীরাই। ৭২০-তে ৭২০ পাওয়া থেকে শুরু করে ৭১৮ বা ৭১৯ পাওয়া নিয়ে যা যা প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সবকটিই গুরুতর অভিযোগ। সরকার কেন লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর বক্তব্যকে উপেক্ষা করছে? নিটের ফলাফলে রিগিং হয়েছে বলে তারা যে ন্যায়সঙ্গত অভিযোগ তুলেছে, তদন্ত চালিয়ে তার নিষ্পত্তি করার দায় কি সরকারের নয়? কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশও নিটে বিরাট দুর্নীতি হয়েছে বলে মন্তব্য করে এক্স-এ লিখেছেন, দেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে সরাসরি জুয়া খেলা হয়েছে। এবারের নিটে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল প্রথমে, যা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। এখন নিটে প্রাপ্ত নম্বর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, একসঙ্গে ৬৭ জন ৭২০-তে ৭২০ পাওয়ায় ফলাফল নিয়ে প্রবল সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কেনই বা ১৪ তারিখ ফল ঘোষণা হবে বলে জানিয়েও তড়িঘড়ি ৪ তারিখে তা প্রকাশ করা হলো, যখন সবাই ভোটের ফল নিয়ে ব্যস্ত, সেও এক গুরুতর প্রশ্ন। অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে জানাতে হবে, কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের প্রতারণা করা হয়েছে ও কে করেছে এবং কেনই বা ৪ তারিখে ফল ঘোষণা এগিয়ে আনা হলো। কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র রণদীপ সূর্যেওয়ালা বলেছেন, এই সরকারের আমলে প্রায় সব পরীক্ষায় রিগিং হয়েছে। নিটে ২৪ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা হয়েছে। কংগ্রেসের আরেক নেতা কানহাইয়া কুমার বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে তদন্ত হোক এবং সেই তদন্তে বেনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে নিট আবার নিতে হবে।
এসএফআই’র সর্বভারতীয় সভাপতি ভি পি সানু এবং সাধারণ সম্পাদক ময়ুখ বিশ্বাস এদিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, এর আগেও এনটিএ’র পরীক্ষা পরিচালনা নিয়ে মারাত্মক অব্যবস্থার অভিযোগ উঠেছে। এবারের নিট নিয়ে যা জানা যাচ্ছে, তাতে প্রমাণিত হলো, এনটিএ একটি অযোগ্য সংস্থা। উপরের দিকে একই নম্বর বা খুব কাছাকাছি নম্বরে বহু ছাত্রছাত্রীকে জায়গা দেওয়া হয়েছে, যাতে এক বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে পড়ার সুযোগ না পায় এবং ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা থাকলে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ভর্তি হতে বাধ্য হয়, যেগুলিতে পড়ার খরচ বিরাট। আসলে মোদী সরকারের আমলে এনটিএ এবং এনএমসি (ডাক্তারি পাঠক্রমের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন) মিলে মেডিক্যাল শিক্ষার বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে তৎপরতা চালাচ্ছে। দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। অবিলম্বে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের ব্যবস্থা করে নিটের দুর্নীতিকে উন্মোচন করতে হবে। সেই সঙ্গে এনটিএ-কে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
Comments :0