শুভ্রজ্যোতি মজুমদার : কোন্নগর
সাহস আর আদর্শবোধে দৃঢ় থেকে লড়াইয়ের শপথ উচ্চারিত হলো বাংলার নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কণ্ঠে। প্রয়াত কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি এবং কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে শনিবার কোন্নগর রবীন্দ্রভবনে সিপিআই(এম)’র রাজ্য কমিটি আয়োজিত সভায় নতুন প্রজন্মের এগারোজন প্রতিনিধি সোচ্চারে ঘোষণা করেছেন, লুট দুর্নীতি সন্ত্রাস সাম্প্রদায়িকতার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে থেমে যাওয়ার জন্য আমরা আসিনি। স্বপ্ন পূরণের পথে আমরা হাঁটবোই, তরুণ প্রজন্ম লড়াই করেই অধিকার আদায়ের পথে থাকবে।
স্বপ্ন-জাগানো দুই প্রয়াত নেতাকে আজকের প্রজন্ম কিভাবে দেখেন, কিভাবে তাঁরা আজকের তরুণদের লড়াইতে অনুপ্রাণিত করছেন তারই আলেখ্য উঠে এসেছে কোন্নগরে এদিনের সভায়। মীনাক্ষী মুখার্জি, দীপ্সিতা ধর, সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতীকউর রহমান, সরোজ দাস, সৌভিক দাসবক্সি, প্রণয় কার্যি, অয়নাংশু সরকার, সপ্তর্ষি দেব, আমজাদ হোসেন, নবনীতা চক্রবর্তী তাঁদের বক্তৃতামালায় প্রয়াত দুই নেতার দেখানো পথেই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য লড়াইয়ের শপথ উচ্চারণ করেছেন। সভাপতিত্ব ও সভার সঞ্চালনা করে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, প্রত্যেক প্রজন্মই সমকালীন সঙ্কট মোকাবিলার সৃজনশীল কৌশল আয়ত্ত করে, সমাজকে এর জন্য তাদের পাশে থাকতে হয়। সীতারাম ইয়েচুরি এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে তাঁদের তারুণ্যের সময়েই নেতৃত্বে তুলে এনেছিলেন তৎকালীন নেতৃবৃন্দ। রাজ্যজুড়ে আজকের তরুণ প্রজন্মও মাথা উঁচু করে লড়ছে, এই এগারোজন তাঁদের প্রতিনিধি হিসাবেই এখানে এসেছেন।
মাথা উঁচু করে অদম্য লড়াইকেই তারুণ্যের প্রতীক হিসাবে চিত্রিত করে মীনাক্ষী মুখার্জি বলেছেন, কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রয়াত হলেও মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য সমাজ বদলের লড়াইতে থেকে নবীনদের খাতায় চিরদিনের জন্য নাম তুলে গিয়েছেন। জানি, দক্ষিণপন্থা এত সহজে জায়গা ছেড়ে দেবে না, কিন্তু আমরাও হাল ছাড়বো না, লড়ে জিতে আদায় করবো বলেই আমরা এসেছি। লড়াইয়ের রাস্তাটা কঠিন। এই রাস্তায় চলার পথে যদি শয়তানের মুখোমুখি না হই, তাহলে জানবে শয়তান আমার সাথে চলেছে। প্রতি পদে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি, কারণ আমরা শয়তানের মুখোমুখি হচ্ছি, তাকে পাশে নিয়ে চলছি না।
লড়াইয়ের রাস্তাটা কত দুর্গম তা বোঝাতে তিনি বলেছেন, সমাজে সবচেয়ে বেশি অপরাধের শিকার হচ্ছে মেয়েরা। আর জি করের নিহত চিকিৎসকের মায়ের কাছে এখন শুধু পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা রয়েছে, তাঁর মেয়েটা আর নেই। দুর্নীতি দুষ্কৃতীর এই রাজনীতির বদল ঘটাতে আমাদের লড়াই শিখিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ছাত্র যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব দীপ্সিতা ধর, প্রণয় কার্যী, সৌভিক দাসবক্সী, নবনীতা চক্রবর্তী, অয়নাংশু সরকার, সপ্তর্ষি দেব, প্রতিকউর রহমান, সরোজ দাস, আমজাদ হোসেনরা বলেন, সীতারাম ইয়েচুরি ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিক্ষা ও কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজ লুট দুর্নীতির রাজত্বে সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আমাদের সমন্বয়ের সংস্কৃতি ভুলিয়ে ধর্ম ভাষার নামে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে অধিকারের লড়াইকে বানচাল করার জন্য নেমেছে বিজেপি তৃণমূল। তরুণ সমাজ এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার কিভাবে এরাজ্যের ছাত্র-যুবদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল তাও উল্লেখ করেছেন এই নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বলেছেন, বামফ্রন্ট সরকার যথাসম্ভব ভূমিসংস্কার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে গ্রামবাংলার প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও জীবনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন তৈরি করেছিল। বাংলার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আধুনিক শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থানের প্রয়াস চালিয়েছিল। আজকে বাংলার বুকে সেই সব স্বপ্ন ছারখার করে দিয়েছে তৃণমূল। তারা বিজেপি’কে সঙ্গে নিয়ে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের রাজনীতি করছে। এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে বাংলাকে রক্ষা করে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে এই প্রজন্মকেই লড়াইতে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়াত নেতাদের ভবিষ্যৎমুখীনতাই নতুন প্রজন্মের মনে এখনও আশা জাগায়, পথ চেনায়। প্রধানমন্ত্রী আর মুখ্যমন্ত্রী চোখ লাল করে আমাদের ভয় দেখিয়ে থামাতে পারবেন না, আমরা লাল ঝান্ডা হাতেই বাংলাকে বাঁচানোর লড়াই লড়বো।
সৃজন ভট্টাচার্য বলেছেন, সীতারাম ইয়েচুরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা আমাদের সহজ করে মানবতা যুক্তিবাদ ভবিষ্যৎমুখীনতা শিখিয়েছেন। এটাই তো বামপন্থা। নয়া উদারনীতির কদর্যতা আমরা দেখে নিয়েছি, বামপন্থাই বিকল্প, এটা এখনই বলার সময় এসে গেছে। এই বামপন্থার লড়াইকে শক্তিশালী করতে পরিচিত বৃত্তের বাইরে গিয়ে মানুষের সঙ্গে মিশে অন্যদেরও টেনে আনতে শিখিয়েছেন প্রয়াত নেতারা। যে যুক্তিহীনতা, অমানবিকতা মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারে, আধখানা রুটি খেয়েও মন্দির বানাতে উন্মত্ত করে তোলে, গাজায় শিশুমৃত্যু দেখেও চোখ বুজে থাকতে বলে, সেটা কখনোই বামপন্থা নয়। ওটাই দক্ষিণপন্থা। আমাদের প্রজন্ম এর বিরুদ্ধে বামপন্থাকে হাতিয়ার করেই লড়বে।
সভার শুরুতে গণনাট্য সঙ্ঘের রাজ্য সভাপতি হিরণ্ময় ঘোষালের নেতৃত্বে শিল্পীরা রবীন্দ্রসংগীত ও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। এদিনের অনুষ্ঠানে দুই প্রয়াত নেতার স্মরণে নন্দন পত্রিকার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত রাজ্যব্যাপী প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার প্রদান করা হয়। হুগলী, হাওড়া, দুই ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বাঁকুড়া, কোচবিহার সহ নানা জেলা থেকে বহু ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করেন। সমকালীন বিষয়ের ওপরে প্রবন্ধ আহ্বান করে চারটি বিভাগে এই প্রতিযোগিতা করা হয়েছিল। প্রতি বিভাগের তিনজন করে কৃতী ছাত্র-ছাত্রীকে এদিন পুরস্কৃত করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা আভাস রায়চৌধুরি, পলাশ দাশ, দেবব্রত ঘোষ, মনোদীপ ঘোষ, তীর্থঙ্কর রায়, প্রবীণ নেত্রী মিতালী কুমার প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট পর্বতারোহী পিয়ালি বসাকও।
Young CPI(M)
মাথা উঁচু করে অদম্য লড়াইয়ে অধিকার ফেরাবে নবীন প্রজন্ম
.jpg)
×
Comments :0