PROBANDHA — BASAB BASAK / NATUNPATA

প্রবন্ধ — সমস্যার গভীরে — বিশ্ব প্রকৃতি / মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

PROBANDHA  BASAB BASAK  NATUNPATA

প্রবন্ধ 

সমস্যার গভীরে বিশ্ব প্রকৃতি
বাসব বসাক

এঙ্গেলস্ সেই কবেই লিখেছিলেন, “আমাদের অবস্থান প্রকৃতির সীমারেখার বাইরে নয়; বরং রক্ত- মাংস-মেদ-মজ্জা-মেধা-মনন সহ আমরা প্রকৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রকৃতির মধ্যেই আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের চাবিকাঠি নিহিত আছে যে সত্যের ওপর তা হ'ল এই যে, প্রকৃতির নিয়মগুলো সঠিকভাবে আয়ত্ব ক'রে সেগুলিকে যথার্থ ভাবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা অর্জনে অন্য সমস্ত জীবের থেকে আমরা অনেকটা এগিয়ে আছি”। কিন্তু মুশকিল হ'ল অভিভোগের দর্শন পুঁজিবাদকে এই সরল সত্যটি অস্বীকার করার স্পর্ধা যোগায়। ফলে পুঁজিবাদ প্রকৃতিকে জয় করবার সদম্ভ এক ভ্রান্ত মানসিকতার বশবর্তী হয়ে আরো বেশি মুনাফার লক্ষে প্রাকৃতিক সম্পদের বাধাবন্ধহীণ লুট অব্যাহত রাখে। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চলতে থাকে নির্বিচার অরন্য হত্যা, অপর্যাপ্ত জীবাশ্ম জ্বালানির দহন অথবা লাগামহীন দূষণ। ফলে মুনাফাশ্রয়ী শিল্পকৃষির যুগে স্বাভাবিক নিয়মেই অন্যান্য জীব প্রজাতি ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে অবলুন্তির অভল অন্ধকারে। মানব সমাজের দখলদারি কোন জায়গায় পৌঁছেছে তা এই তথ্য থেকেই স্পষ্ট হতে পারে যে পৃথিবীর প্রাথমিক উৎপাদক অর্থাৎ সবুজ উদ্ভিদের ২৫ থেকে ৪০ শতাংশই খাদ্য হিসাবে ব্যবহার ক'রে মানুষ ও তার গৃহপালিত পশুরা অথবা স্বনচর মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই হয় মানুষ, নয় তো মনুষ্য পালিত পশু। বাকি মাত্র ৩ শতাংশ মেরুদন্ডী অরন্যচারী। তারমানে অন্যান্য জীবগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত বাস্তুতান্ত্রিক বাসভূমির প্রায় পুরোটাই আমরা দখল করে বসে আছি। আসলে শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত হারে বেড়েছে নগরায়ণ, যার প্রত্যক্ষ অভিঘাতে একদিকে যেমন ব্যহত হয়েছে জীব-ভূ রাসায়ণিক চক্র, তেমনি অন্যদিকে ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়েছে প্রকৃতি, বাস্তুচ্যূত হয়েছে অসংখ্য জীব প্রজাতি। হিসাব বলছে বিশ্বে বসবাসকারী প্রাণীদের সংখ্যা আজ ১৯৭০ সালের তুলনায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে।

 সিএনএন-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা যত ফল আর সবজি খেয়ে থাকি তার এক তৃতীয়াংশ জন্মাতোই না যদি না মৌমাছিরা থাকতো। জার্মানির উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌমাছি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জোফেরগেন টাউটজ দেখিয়েছেন কুমড়ো থেকে শুরু ক'রে ভরমুজ এমন প্রায় ১৩০০০০ উদ্ভিদ পরাগমিলনের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে মৌমাছিদের ওপর নির্ভরশীল। অথচ শিল্পকৃষির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অর্গানোক্লোরিন বা অর্গানোফসফেট জাতীয় রাসায়নিক কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে গত ২৫ বছরে মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ প্রজাতির শতকরা ৭৫ ভাগই চিরকালের মত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডাভে গাউলটন আমাদের তাই এই কথা বলে সতর্ক করছেন যে আমরা যদি এই হারে পতঙ্গ প্রজাতিকে হারাতে থাকি তবে সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন। তিনি আরও বলছেন, বর্তমানে আমরা বাস্তুতান্ত্রিক মহাবিনাশের পথে ('Ecological Armageddon) অতি দ্রুত এগিয়ে চলেছি। যেকোনো বাস্তুতন্ত্রেই খাদ্য শৃঙ্খল ও শক্তি প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হ'লে সেই বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদক নানান সবুজ গাছপালা থেকে শুরু ক'রে বিভিন্ন স্তরের নানান খাদক প্রজাতি, এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিয়োজক ব্যাকটেরিয়া সব্বাইকেই যে দরকার এই সরল সত্যটা আমরা অনেক সময় বুঝতে চাই না কিছুতেই। গতবছর (২০১৯) আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র দিবসের ঠিক দু'দিন আগে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধীন ইন্টারগভর্মেন্টাল সায়েন্স পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডায়ভার্সিটি এ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস (IPBES) বেশ কয়েক বছর ধরে কয়েক'শ বিজ্ঞানী মিলে অনেক খেটে খুটে তৈরি করা যে রিপোর্টটি পেশ করে ভাতে বলা হয় অন্তত ১০ লক্ষ প্রজাতি এই মুহূর্তে অবলুপ্তির পথে। ওই মঞ্চের সভাপতি রবার্ট ওয়াটসন লিখেছেন গভীর আশঙ্কার কথা, “The overwhelming evidence of the IPBEST Global Assessment...presents an ominous picture. The health of ecosystems on which we and all other species depend deteriorating more rapidly than ever.'। তবু কি সাবধান হয়েছি আমরা। তাঁর কথায় 'আমরা আমাদের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও জীবনের গুণগত মানের মূল ভিত্তিটাকেই ধ্বংস করে চলেছি।

 ইন্টারপোলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কম ক'রে ২০ বিলিয়ন ডলারের বন্যপ্রাণের অবৈধ ব্যবসা চলছে বিশ্বজুড়ে। অন্য সব দূষণের কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, ফি বছর ১০ লক্ষ টন প্লাস্টিক মিশছে সমুদ্রে, আর সেই প্লাস্টিক দূষণের ফলে মারা যাচ্ছে বিরল তিমি মাছ থেকে কচ্ছপ — নানা জাতের সামুদ্রিক প্রাণী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনেও হারিয়ে যেতে বসেছে একাধিক প্রজাতি। যারা ভাবছেন কোভিড- ১৯ এর জন্য বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারনে জলবায়ুর অসুখ বুঝি সেরে উঠছে, তারা যে কতখানি ভুল ভাবছেন সেটা আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল ওশিয়েনিক এ্যান্ড এ্যাটমোস্ফেরিক এ্যাসোসিয়েশনের (NOAA) সাম্প্রতিকতম রিপোর্টটি দেখলেই স্পষ্ট হবে। NOAA-র এ বছরের এপ্রিলের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১৬.২১ প্রতি ১০ লক্ষের অংশ ভাগ (ppm), যা কিনা ১৯৫৮ সালে যখন হাওয়াই দ্বীপে প্রথম কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘণত্ব মাপা শুরু হয়েছিল, তারপর থেকে সর্বোচ্চতম পরিমাপ। ফলে অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু সঙ্কটের হাত থেকে আমাদের মুক্তির কোনো দিশা দেখা যাচ্ছে না। যুগ যুগ ধরে আম্ফানের মতো হাজারো সাইক্লোনের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেছে যে সুন্দরবন, জীবাশ্ব জ্বালাণির অপরিমিত দহন আর প্রাকৃতিক সম্পদের বাধাবন্ধহীণ লুটের কারনে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় সেই বাদাবনের ৩৫ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে গত পঞ্চাশ বছরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এক কালে এ রাজ্য সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পের সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়ে নজির সৃষ্টি করেছিল। অথচ সেই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতগুলোই আজ পরিণত হয়েছে গাছ চোরদের ঘুঘুর বাসা। আম্মান বিধ্বস্ত দক্ষিণ বঙ্গে এই মুহূর্তে যদি বৃক্ষরোপণের যথাযথ পরিকল্পনা না করা যায় তবে আগামি দিনে আরও বড় বিপদ ঘনিয়ে ওঠার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

 

 

 

 

 

 


 

Comments :0

Login to leave a comment